
লাল সবুজের নাশপাতি
বাইশ বছর ধরে
এই ঘরটিতে আমি বন্দি।
এতগুলো বছর ধরে
কথা বলেছি,
খয়েরি রঙের মেঝের সাথে,
কিংবা ছাদের ঝুলে দুলে ওঠা
ডিমওয়ালা মাকড়সাটির সাথে,
এককোণে রাখা, নীল কাচের একখানা শিশি,
ছিপি খুলে বহুবার,
পরখ করেছি তার বাঁশি হয়ে ওঠা শরীরটি।
ঝুপ করে নেমে আসে যে সবুজ আঁধার,
তার সাথে কথা হয়েছে আমার।
আঁধারের এই ডুবুডুবু খেলায়,
নিজেকে শূন্যের নকশা মনে হয়,
মনে হয় আমি একা নই,
আমার চারপাশে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য আমি,
রক্তের মধ্যে গর্ত সৃষ্টি করেছে
অন্তত একশত আমি।
হৃদপিণ্ডের মতো কাঁপতে কাঁপতে
আমার চৈতন্য, আকাঙ্ক্ষা, তৃপ্তি
হারিয়ে ফেলেছে আত্মমৈথুনের বোধ,
আমি হয়ে উঠেছি
একগুচ্ছ অন্ধকারে দুলে ওঠা
জ্বলজ্বলে আঁধার।
বহুবছর। আজ বহুবছর পর,
অন্তত বাইশ কিংবা তেইশ হবে
খয়েরি রঙ ক্ষয়ে গেছে,
শিশি আর তেমন নেই; আগের মতো,
ডিমওলা মাকড়শাটি মরে গিয়ে,
ঝুল হয়ে দুলছে ক্রমাগত।
আজ আমার মনের ভেতরে
বাহির দেখার নেশা জাগে,
নেশা জাগে
পালকি পালকি আলো দেখার,
নেশা জাগে
অরণ্যের অনুভূতিতে
আলোর চেয়ে সতেজ হয়ে উঠবার।
নেশার এ বোধ পেয়েছি
রক্তনালির ভেতর থেকে,
যেখানে রক্তের উন্মাদনা চেয়ে দেখার মতো,
যেখানে সামুদ্রিক বাতাস যৌবন হয়ে ওঠে
শরতের দিনের মতো।
দেরি না করেই
আমকাঠের জানালার একপাশ
খুলে ফেলি সহজেই।
মুক্ত চোখে
জানালা পেরিয়ে বাইরে তাকাই,
জ্যোৎস্নায় ভেসে যায় আমার মুখ,
মনে হয়
পূর্ণ চাঁদের নিচে বসে আছি
চারদিকে খরস্রোতা নদীর ঢেউ,
ঢেউয়ে ঢেউয়ে বাইছি সবুজ পানসি
মৃদু শব্দ হচ্ছে ভারি বৈঠায়,
পাশের আমনখেত পেরিয়ে
দূরে। ঠিক বিলের ওপারে,
জ্বলছে একটি আকাশ প্রদীপ,
একাধিক হিজলবন তার পাশে
ফেলেছে ছায়া দুলে দুলে।
আমার ধ্যান ভাঙে
যখন কুয়াশার গন্ধ এসে মুখে লাগে,
তেরহাতি নারকেল গাছটির চিরল-বিরল পাতা
ঝিরঝির হাওয়ায় যখন করে ঝিলিমিলি,
তখন অরণ্যসুগন্ধে রক্ত ভরে উঠতে চায়,
তরল সৌন্দর্য ফুসফুসে ঢুকতেই
টলমল করে ওঠে সারা শরীর,
আমি হয়ে উঠি নিশির শিশির।
আকাশের পরিপূর্ণ শান্তি যেন
দেহের তারায় তারায়,
হয়ে ওঠে লাল সবুজের নাশপাতি।
পূর্বমেঘ
এখন সকাল,
জানালা ভেঙে
পায়ের পাতায় পড়ছে নরম রোদ।
বাতাসে মলমল করছে রৌদ্রগন্ধ।
সবুজ তাঁবুতে ছেয়ে যেন চারপাশ।
এইসব দিন
যোনি থেকে খসে যাওয়া কাঠগোলাপের মত;
ছায়া এড়ায় না।
যেন শালিধান মেলানো ছাদে ভুবনচিল;
মায়া এড়ায় না।
আমার ভেতরে তখন অদ্ভুত মায়া; মেঘ
আমার ভেতরে তখন অদ্ভুত ছায়া;বৃষ্টি
হয়তো বৃষ্টি হচ্ছে দূরে,
সৌখিন মূর্খের মত
আমি শব্দ পাই।
জানালার ওপাশে
গাঁড় নীল রঙের ছোট্ট ডোবায়
ছায়া পড়ে মেঘের,
অপূর্ব সেই জলে,
নকশা করা ময়ূর
পেখম মেলে নাচে।
এইসব দৃশ্যে
আমি অনেক হয়ে উঠি,
অতঃপর
আঁধার ডোবানো নদী থেকে
তুলে আনি অস্তিত্বের শেষ নোঙর;
পেরোতে চাই বহুপথ।
তবু গির্জার ভেতরের বাতাস
খসে পড়ে অনিদ্রায়,
আমি শব্দ পাই, অবিরাম শব্দ পাই;
দীর্ঘ ব্যবহারে দাগপড়া জীবনের শব্দ।
যে স্রোতে স্রোতে আচ্ছন্ন
অতঃপর রিক্ত অথবা স্নিগ্ধ।
বাইরে শুধু মাঠ,
সূর্যাস্তের আভায় আবৃত।
শুন্যতা একা নেই,
তাকে পূরণ করেই কেউ।
কবি পরিচিতি: অহ নওরোজের জন্ম ১২ জুন বাংলাদেশের ঝিনাইদহে। বেড়ে উঠেছেন যশোরের অভয়নগরে। বর্তমানে ঢাকায় বসবাস করেন। পেশা-লেখালেখি। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ দুইটি- নীল নৌকার নারী এবং রোমন্থনের সনদ।
নিউজনেক্সটবিডি ডটকম/এসপিকে/এসজি