
কাজি ফৌজিয়া:
প্রিয় বন্ধু,
কেমন আছ তুমি? আজকাল তোমার শরীরটা বেশি ভালো থাকে না, তাই আমার অনুরোধ—নিজের প্রতি খেয়াল রেখো। আমার মনে হয় তুমি নিজের ওপর জুলুম করে কাজ কর। ঠিকমত খাবার খাও না, আজকাল সিগারেট টাও বেশি খাচ্ছ; আর কত ঘণ্টা কাজ কর তার তো কোন হিসাবই রাখ না। বন্ধু, দয়া করে নিজের জন্য কিছু সময় বের কর, আর বিশ্রাম কর। ইস! কত উপদেশ দিয়ে ফেললাম, তোমার তো আবার উপদেশ-এ মেজাজ খারপ হয়। তোমার বন্ধু তো আমি, এই একটাই যে নিজের থেকে তোমার বেশি ভাল চাই। তাই আমার সাথে রাগ নয় বন্ধু।
চিঠিতে কী লিখব বুঝি না—চারিদিকে এত যন্ত্রণা, প্রতিদিন আমরা ঘুম থেকে উঠে তাকিয়ে থাকি ঐ ট্রাম্প এর দিকে, যে আজ কাদের সর্বনাশ হবে। প্রতিদিন ডজন খানেক সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে সাংবাদিকদের উপহাস আর নির্বাহী আদেশ দেওয়া ছাড়া এর যেন আর কোন কাজ নেই। এমন বেয়াদব, বর্ণবাদী আর জোকার প্রেসিডেন্ট আমেরিকার ইতিহাসে আর কেউ ছিল কি না সন্দেহ আছে। আজকাল অনেক মানুষকেই বলতে শুনি—আমেরিকার পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়েছে তাই আজ তাদের এমন সর্বগ্রাসী সর্বনাশী প্রেসিডেন্ট। আমি বলি, হ্যাঁ, তা ঠিক; কিন্তু সমস্যা হল আমরাও এই দেশে আছি তাই মূল্যটা আমাদেরও দিতে হবে।
আমাদের মত অভিবাসীদের কথা বাদ দিলাম খোদ আমেরিকার নাগরিকরা আশাহত হয়েছে ট্রাম্প এর কীর্তিকলাপে। একটা গুরুত্বপূর্ণ জরিপে দেখা গেছে ৫৬ শতাংশ মানুষ তার কাজকর্ম সমর্থন করছে না, আমেরিকায় এর পূর্বে এত কম সময়ে কোন প্রেসিডেন্ট জনসমর্থন হারায়নি। ট্রাম্প এর শত্রুর তালিকা অনেক লম্বা—অভিবাসী, কালো, জুইস, মহিলা, লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্স, মুসলিম সকল সমাজের মানুষ তার রোষানলে পড়েছে। আজ জুইস মুসলিম এক কাতারে দাঁড়িয়েছে। যে সকল রাজনীতিবিদের অফিসের সামনে গত বছরও আমরা অধিকার আদায় এর প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে গিয়েছি সেও আমাদের সাথে আজ মিছিলে। মেয়র গভর্নর সিটি কাউন্সিল মেম্বার কেউ বাদ নেই যে প্রতিবাদ সমাবেশ করছে না।
গত ১০ বছরের অভিবাসী জীবনে আমি এক সপ্তাহে এত প্রতিবাদ সমাবেশ দেখি নাই। আমাদের সাইড থেকে আমরা যতই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করি না কেন সে তার সাফল্যের ঢোল একলা বাজিয়েই চলছে। ট্রাম্প দাবী করছে, সে অনেক সফল—যদিও তার নির্বাহী আদেশ আদালত সব জায়গায় আটকে দিয়েছে। রাশিয়ার সাথে গোপন মিটিংয়ের কারণে তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা ফ্লিন পদত্যাগ করেছেন। তার কর্মকর্তা অনেকেই রাশিয়ার সাথে গোপন সম্পর্ক রাখছে। ট্রাম্প এর প্রতিটি প্রশাসনিক নিয়োগ হুমকির মুখে পড়ছে, কোন কোন ক্ষেত্রে ডেমোক্রেট সিনেটররা রাতভর শুনানি করেছে তার পরিষদ মনোনয়ন ঠেকাত। সাংবাদিকদের সাথে রীতিমত শত্রুতামুলক সম্পর্ক তৈরি করছে—তবু নাকি সে সফল।
বন্ধু, গত সপ্তাহে গিয়েছিলাম একটি সমাবেশ—যার নাম ছিল আইস ফ্রী এনওয়াইসি মানে ইমগ্রেশন পুলিস মুক্ত নিউ ইয়র্ক সিটি। সমাবেশের পর মিছিল নিয়ে আমরা যখন ম্যানহাটন রাস্তা দিয়ে এগুচ্ছিলাম পুলিশ বাধা দিল, আমরা তাদের উপেক্ষা করে এগিয়ে যেতেই আমার ডান বাম থেকে ৫ জন আটক ,আমি আর সায়মা আপা কোন রকমে বেঁচে গেলাম। গত বৃহস্পতি বার হলো স্ট্রাইক ডে উইথ আউট ইমিগ্রেন্ট, অনেক মানুষ কাজে যায়নি—হাজার হাজার অভিবাসী বিভিন্ন শহরের রাস্তায় মিছিল করেছে। এই সপ্তাহে হচ্ছে প্রেসিডেন্ট ডে বন্ধ, সেদিনও স্ট্রাইক হবে। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস—সেদিন বড় মিছিল করার পরিকল্পনা চলছে, যার নাম দিয়েছে ডে উইথ আউট ওমেন্স। বন্ধু, তোমাকে আমি চিঠি লেখা শুরু করে একদিনে শেষ করতে পারি না, কয়েকদিন লেগে যায়। ১৬ তারিখে শুরু করলেও আজ ২০ তারিখ—তার মানে ট্রাম্প ক্ষমতার ৩০ দিন। গতকাল নিউ ইয়র্ক ম্যানহাটনের টাইম স্কয়ারে হয়ে গেল আই এম এ মুসলিম টুঁ সমাবেশ, মুসলিম ব্যান এর প্রতিবাদে জুইসরা আয়োজন করে এই সমাবেশ। মেয়র থেকে সব ছোট বড় নেতারা ছিল হাজির জনগণও বিপুল উদ্দীপনায় যোগ দেয় নিজেদের মুসলিম ঘোষণা দিতে। আমি মাঝে মাঝে ভাবি ট্রাম্প এর আঘাত তো আমাদের মুসলিমদের জন্য শাপে বর হয়ে গেল। এত সহানুভূতি মুসলিম সমাজ আর কখনো পেয়েছে বলে ইতিহাসে নেই। প্রতিদিন ছোট বড় কোন মিছিল বা সমাবেশ হতেই থাকে। আমেরিকা এখন মিছিলের দেশ, শ্লোগান আর লড়াই এর দেশ, তথাকথিত স্বপ্নের দেশে এখন দুঃস্বপ্নের যমদূত রাজ করে।
বন্ধু, আমেরিকার কথা কী বলব কী বাদ দিব—সেটাই সবচে বড় সমস্যা। এত সমস্যার কূল পাওয়াই মুস্কিল। গত সপ্তাহে জাপান আর কানাডার প্রধানমন্ত্রীর সাথে কূটনৈতিক বৈঠক করে বেশ সমালোচনার মুখে পড়ে। কূটনৈতিক শিষ্টাচার বলে সে কিছুই মানে না, আজব আজব কান্ড করে মিডিয়া গরম রাখছে। একটা বিষয় ভাবার মত, প্রায়-ই দেখা যাচ্ছে তার বিভিন্ন গোপন খবর লিক হয়ে যাচ্ছে, এমন একটি খবর ছিল সে নাকি মিলিটারি নামাতে চেয়েছে কাগজপত্র ছাড়া মানুষ আটক করতে। ট্রাম্প প্রশাসন জোর গলায় তা অস্বীকার করছে। বিভিন্ন রাজ্যে ইমগ্রেশন পুলিশ অপরাধের সাথে কোন রকম সম্পৃক্ততা ছিল এমন মানুষ আটক করেছে। বিভিন্ন রাজ্যের আটক সংখ্যা ৬০০ কাগজপত্র বিহীন অভিবাসী আর নিউ ইয়র্ক থেকে ধরেছে ৪১ জন। বেশীর ভাগ আটক কৃতরা ল্যাটিন আমেরিকান। বন্ধু, আমি অনেককেই বলতে শুনি ট্রাম্প যা করছে ঠিক করেছে, অপরাধীদের কেন রাখবে? কষ্ট হয় বন্ধু, খুব কষ্ট হয়। গতানুগতিক সমাজের অপরাধীর সংজ্ঞা কী বুঝি না! মদ খেয়ে গাড়ি চালিয়েছে অপরাধি, নকল ব্যাগ বিক্রি করেছে অপরাধী, নকল সুগন্ধি বিক্রি করে অপরাধী, স্বামী রাগ করে স্ত্রী বা সন্তানকে মেরেছে অপরাধী কত রকম অপরাধী আছে এই তালিকায়! সাজা খেটেছে রেহাই পেয়েছে বা সাজা হয়নি শুধু আটক হয়েছিল, বা মামলা চলছে সবাই অপরাধী। অনেকের স্ত্রী সন্তান আমেরিকান নাগরিক তবু তাদের যেতে হবে! আমার বা আমাদের মত মানবাধিকার কর্মীরা মেনে নিতে পারি না যে এরা অপরাধী, আমরা চাই না তাদের ছোট খাট ভুলের জন্য তাদের পরিবার থেকে তাদের আলাদা করা হোক। তাই আমরা তাদের রক্ষার জন্য রাস্তায় আন্দোলন করেই যাব।
গত ২ সপ্তাহ ধরে একটি বিষয় আমাদের মহাঝামেলায় ফেলেছে, ইমিগ্রেশন পুলিশ নিউ ইয়র্ক থেকে ৪১ জনকে আটক করেছে—এটা ঠিক। কিন্তু যেটাকে বলে রেইড, তেমন কিছু হয়নি। যাদের ধরেছে, হয় বাসার সামনে বা কাজে যাওয়ায় সময় বা হাজিরা দিতে গেলে আটক করেছে। ইমিগ্রেশন পুলিশের রেইড হলো, একটা এলাকায় অভিযান চালিয়ে অনেককে আটক করা—যা গত ৩০ বছরে নিউ ইয়র্কে হয়নি। কিন্তু গত ২ সপ্তাহ ধরে সামাজিক মাধ্যমে শুধু রেইড এর খবর! কখনো জ্যাকসন হাইটস কখনো জামাইকা কখনো ব্রুকলিন কখনো করোনা। জায়গা একদিনে ৩ বার বদল হয়, তদন্ত করতে করতে আমাদের অবস্থা কাহিল। আমি তো মেম্বারদের কাছ থেকে দিনে ১০টা কল পাই শুধু একটাই প্রশ্ন—রেইড এর খবর সত্যি কি না? আমাদের সংগঠন সামাজিক মাধ্যমে গুজব না ছড়ানোর পরামর্শ দিয়ে একটা নির্দেশিকা দিয়েছে, কী করে সত্যি মিথ্যা আলাদা করবে। একটা কথা আছে, গুজব জিনিসটা বাতাসে ওড়ে। আজ এক সাংবাদিক নামক সাংঘাতিকের সামাজিক মাধ্যমের পোস্টে মন্তব্য করেও উঠিয়ে নিলাম, সে যা লিখেছে তা ভুল ও সমাজের কিছু মানুষকে ইঙ্গিত করে লেখা। সে নিজেকে মনে করে আমেরিকান আর ট্রাম্প এর ভক্ত। লেখাটি দেখলেই বোঝা যায় সে মহাখুশি কাগজপত্রবিহীন মানুষকে বের করে দেবে এই জন্য। মানুষ কী করে ভুলে যায় নিজের অতীত, নিজেকে আমেরিকান মনে করা বাঙালিরা নিজেদের ভাবে বড় দেশপ্রেমিক, মানে প্রয়োজনে বাঙালি আবার প্রয়োজনে আমেরিকান। আমরা না ভাল বাঙালি হলাম আর আমেরিকান হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। অনেক দিন ফেইস বুকে কিছু লিখি না। আজ এসব দেখে রাগ করেই লিখালাম। সবাইকে অনুরোধ করলাম গুজব না ছড়াতে, যদি ইমিগ্রেশন পুলিশ দেখে আমাকে জানাতে অনুরোধ করলাম। আমাদের সংগঠন আপৎকালীন তদন্ত ও তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেয়ার দল গঠন করেছে। এদের কাজ হল ইমিগ্রেশন পুলিশের রেইড খবর পাওয়া মাত্র তদন্ত করা ও ব্যাবস্থা নেয়া। আমিও আছি এই দলে। সেদিন এমনই এক খবরের ভিত্তিতে সকাল ৫টা থেকে ৮টা রাস্তায় টহল দিলাম। আমাদের কাহিনী বলতে গেলে রামায়ণ হবে। এখন তাই অন্য একটি কথা বলে চিঠি শেষ করব।
বন্ধু, ইমিগ্রেশন জেল এর বন্দীদের নিয়ে কাজ করেছিলাম গত বছর—মনে আছে তোমার? এখনো কয়েদিদের ফোন আসে কারাগার থেকে। যারা বহিষ্কার হয়ে চলে গেছে অনেকে বাংলাদেশ থেকে ফোন করে, অনেকে আবার চলে গেছে ব্রাজিল বা লিবিয়া। ব্রাজিল থেকে তারা আবার আমেরিকা আসবে আর লিবিয়ার লোকজন ইতালি যাবে। বাইরে যারা আছে অনেকে তারা কানাডা যাওয়ার চিন্তা করছে। আমি এই ছেলেগুলিকে যতটুকু দেখেছি আমার মনে হয় এত নগর দেশ পাড়ি দিয়ে জীবনে এত ঝুঁকি নিয়ে পথ পাড়ি দিয়ে জেল খেটে ঝুঁকিকে ঝুঁকি মনে করে না। জীবনের প্রতি এক তাচ্ছিল্য এসে গেছে, যে কোন মুল্য দিতে প্রস্তুত তবু তারা বিদেশেই যাবে বা কাগজপত্র বানাবে। যাই হউক, আমি এদের নিয়ে এত কথা বললাম তার কারণ আছে। গত সপ্তাহে একটি খবর বের হল যে আরমান হসাইন নামের বাংলাদেশী একটি ছেলে দুর্গম পথে আমেরিকা ঢুকতে গিয়ে পানিতে ভেসে গেছে বা মারা গেছে। চার দিন পূর্বে আরমান এর বাড়ি থেকে তার ভাই কল করে আমাকে সব কিছু জানায়। তারা আমাদের সহযোগিতা চায় আরমানের লাশ খুঁজে পেতে ও বাংলাদেশে ফেরত নিতে। আমি তার ছবি ও পরিচয়পত্র পাঠাতে বলি। যখন ছবি আর পরিচয় পত্র আসে কষ্টে আমার বুকটা ফেটে যায়, কি সুন্দর একটা বাচ্চা ছেলে যার জন্ম ১৯৯৫ সালে। এই তরুণ প্রাণ অকালে ঝরে যাবার জন্য কে দায়ী—আরমান/দালাল/পরিবার নাকি আমাদের সরকার যে সব জেনেও দালালদের এই ভয়ঙ্কর ফাঁদ থেকে মানুষকে মুক্ত করার কোন চেষ্টা-ই করছে না? আমরা আরমানের লাশ ফেরত পাওয়ার চেষ্টা করছি—দেখা যাক কী হয়। আমার দেশের মানুষের কাছে একটা অনুরোধ—যেখানেই এই জাতীয় দালাল এর ফাঁদ চোখে পড়বে মানুষকে সতর্ক করুন।
ভাল থাক বন্ধু, ভাল থাকুক দেশ ও দেশের মানুষেরা।
ইতি
তোমার বন্ধু, যাকে তুমি কোন নামেই ডাকো না

লেখক: মানবাধিকার কর্মী