
কাজী ফৌজিয়া
আজ আমি আপানাদের ঝালমুড়ি দাদা বা জ্যকসন হাইটস এর বাউল দাদার কথা বলব। উনার নাম সানওয়ার আহমেদ কিন্তু জীবন জীবিকার সংগ্রাম উনাকে নতুন নাম দিয়েছে ঝালমুড়ি দাদা বা বাউল দাদা।বাউল গান গেয়ে বা নিজের জীবনের দুঃখ কষ্টের কথা গানে গানে প্রকাশ করে ঝালমুড়ি বিক্রি করেন তিনি। ঝালমুড়ি দাদার জন্ম বাংলাদেশের মৌলভীবাজারের দক্ষিণ বালি গ্রামে। দাদা ঠিকমত সন তারিখ বলতে পারেনা তবে যুবক বয়সে জীবন জীবিকার তাগিদে সে গলা কাটা পাসপোর্ট নিয়ে দুইবার লন্ডন যায় কিন্তু দুইবার ই ধরা পরে তিনি বাংলাদেশে ফেরত যায়। আমাদের ঝালমুড়ি দাদা হেরে যাওয়ার মানুষ নন তাই উনি লন্ডন থেকে বাংলাদেশে ফেরত গিয়ে চেষ্টা তদবির করে ইরাক চলে যান। ভাগ্য সেখানেও সুপ্রসন্ন হয়নি আড়াই বছর পর ইরান ইরাক যুদ্ধ লাগে সেই কারণে আবারো তাকে বাংলাদেশে ফেরত যেতে হয়। ইরাক থেকে ফেরত গিয়ে দাদা ২ মাস বাংলাদেশে থাকেন তারপর তিনি কুয়েত চলে যায়। কুয়েত থেকে ফেরত যাওয়ার পরে এক দালাল কে পাঁচ লক্ষ টাকা দিয়ে দাদা আমেরিকা চলে আসে।
দাদার আমেরিকা জীবন ও কম বৈচিত্র্যময় নয়, আমেরিকা এসে সে কাজ নেয় নিউ ইয়র্কের রকোফেলো টাওয়ার এর লালবাগ রেস্টুরেন্টে, তান্দুরি সেইফ হিসাবে। একে একে বোম্বে মসলা, ক্যালকাটা রেস্টুরেন্ট ,গান্ধী রেস্টুরেন্ট, সম্রাট রেস্টুরেন্ট কাজ করে বাউল দাদা।তিনি পেন্সেল্ভেনিয়া ও মিনিসোটা তেও তান্দুরি সেইফ হিসাবে কাজ করেন। যখন বাউল দাদা নিউ ইয়র্কে ফিরে আসেন তখন এখনকার প্রিমিয়ার রেস্টুরেন্ট তদান্তিন আলাউদ্দিন রেস্টুরেন্টে কাজ করেন ওটাই উনার সর্বশেষ রেস্টুরেন্টে কাজ। বয়সের ভারে বাউল দাদা যখন ক্লান্ত কেউ আর তাকে কাজে রাখেনি। দাদা মনে করতে পারে না কবে থেকে সে ঝালমুড়ি বেচা শুরু করে, উনার বক্তব্য আলাউদ্দিন এর কাজ যাওয়ার পরেই আমি জ্যকসন হাইটস এ ঝালমুড়ি বেচা শুরু করি। দাদা ঝালমুড়ি বেচার জন্য ভেন্ডর লাইসেন্স ও যোগাড় করেন। বাউল দাদা কে পুলিশ প্রতি সপ্তাহে টিকেট দিয়ে যেত কেন উনার প্রপার ভ্যান নাই ঝালমুড়ি বিক্রি করার জন্য তাই জরিমানা টিকেট।দাদা মাসে মাসে কোর্টে যেত আর টিকেট এর টাকা প্রদান করত। দাদা নিজেও জানে না আজ পর্যন্ত কত টাকা উনি কোর্ট কে প্রধান করেছে। দুই বছর পূর্বে জ্যকসন হাইটস ব্যবসায়ী রা যখন ভেন্ডর দের রাস্তা থেকে পুলিশ দিয়ে উঠিয়ে দেয় তখন অন্যান্য দের মত বাউল দাদা ও ড্রাম এ আসে সাহায্যের আবেদন নিয়ে। অনেক সংগ্রামের পর আমরা যখন সফল হলাম সব ভেন্ডরদের রাস্তায় আবার বসাতে ও ব্যবসা শুরু করতে তখন জ্যকসন হাইটস এর ব্যবসায়ীরা অন্য ভেন্ডর দের তো কিছুটা ছাড় দিলেও বাউল দাদার ভাগ্য তেমন পরিবর্তন হল না। রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীরা মনে করে দাদার ঝালমুড়ি খেয়ে মানুষের ক্ষুধা মিটে যায় তাই তাদের খাবারে বিক্রি হয় না তাই তারা প্রায়শ পুলিশ কল করে উনাকে হয়রানী করতে। পুলিশ এসে বাউল দাদা কে টিকেট দিয়ে যায়। আমি বাউল দাদার সব টিকেট হিসাব করে দেখলাম উনার টিকেট প্রায় পাঁচ হাজার ডলার যা জরিমানা হিসাবে দিতে হবে কোর্টে। আমি উনার জন্য ফ্রি লইয়ার এর ব্যবস্থা করলাম, লইয়ার নিজেই কোর্টে গিয়ে কিছু মাফ করাল কিছু পারল না । গত ২০১৬ সালে কেউ একজন পুলিশ কে কল না করে হেলথ ডিপার্টমেন্ট কল দেয়, হেলথ ডিপার্টমেন্ট এসে বাউল দাদার ঝালমুড়ি বানানোর গাড়ি সব জিনিসপত্র উঠিয়ে নিয়ে যায় । আমরা অনেক খোঁজ নিয়ে জানলাম তারা সব জিনিসপত্র গারবেজ করে দিয়েছে। আমাদের লইয়ার বলল অনেক ভেন্ডরদের সাথে হেলথ ডিপার্টমেন্ট এমন আচরণ করে সুতরাং আমরা যদি রাজী হই তবে তাদের সাথে মিলে বাউল দাদা হেলথ ডিপার্টমেন্ট এর নামে কেস করতে পারবে।আমি বাউল দাদাকে বুঝিয়ে বাউল রাজী করালাম ও আমরা হেলথ এর নামে কেস করলাম। অনেকে সেদিন আমাদের প্রশংসা করেছে অনেকে আমাদের পাগল বলেছে । মানুষ মনে করে একজন বয়স্ক গরীব ঝালমুড়ি ওয়ালার জন্য আমাদের এত দরদ কেন কি স্বার্থ আমাদের। আমি মানুষের চিন্তা কন্ট্রোল করতে পারি না শুধু বুঝলাম আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজ থেকে আসা মানুষেরা এই দেশে এসে ওয়ার্কিং ক্লাস তো হয়ে যায় কিন্তু চিন্তা চেতনায় মধ্যবিত্ত ই থেকে যায়। হয়ত এই কারণেই তাদের দোকানের সামনে কোনো ঝালমুড়ি ওয়ালার গান আর বেচা বিক্রি করা তাদের পছন্দ নয়।
যাই হউক হেলথ ডিপার্টমেন্ট যখন বাউল দাদার জিনিসপত্র ফেলে দিল তখন উনার রুটিরুজি পুরাপুরি বন্ধ হয়ে গেল পুজি বলতে আর কিছু নাই। আমি আর আমার নেপালি সংগঠক আনসু বাউল দাদা কে তিনশ ডলার দিলাম উনি আবার নতুন করে জিনিসপত্র কিনে বসলো রাস্তায়। পূর্বের মত জমজমাট হল না কিন্তু ছোট করে শুরু করল লাভ হল না, পুলিশ আসা বন্ধ হল না প্রায় ই পুলিশ আসে আমি দৌড়ে যাই পুলিশের সাথে লড়াই করতে। প্রচণ্ড শীতের সময় তুষারপাতের সময় গুলিতেও দাদা বসে থাকে না রাস্তায় বসে আয় উপার্জনের চেষ্টা করে, মাঝে মাঝে টাকা না থাকলে আমার অফিসে আসে আমি যা পারি দেই নিতে চায় না জোর করে হাতে গুজে দেই দাদা চলে যায়। গত বছর ইউ কে থেকে এক আর্টিস্ট আসে আমাদের অফিসে একটা প্রোগ্রাম করতে। সে আমেরিকার ত্রিশ বছরের বেশী সময় থাকা বাঙালি যে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ীর খোঁজ করে তাদের ইতিহাস জানতে। আমি তাকে বলি বাউল দাদার কথা যে সে অনেক বছর বাবুর্চি ছিল এখন ভেন্ডর।আর্টিস্ট এর নাম মোহাম্মদ আলি আএরসল সে ইউ কের বারমিংহাম এর বাসিন্দা ।বাউল দাদার ঘরে গিয়ে সে তাকে ইন্টার্ভিউ করে তারপর ইউকে ফিরে গিয়ে সে বাউল দাদার ও তার ঘরের একটা ছবি আঁকে,সেই ছবি টি সে ব্রুকলিন ফুড এন্ড কালচার মিউজিয়াম এ বাঙালির ফুড এন্ড কালচার ইতিহাস হিসাবে জমা দেয় ও মিউজিয়াম এর লোকজন এর আর্ট টি খুব পছন্দ করে। তারা বাউল দাদার রুমটি একদম তেমন করেই বানাতে চায় যেমন করে সে থাকে এখন।মোহাম্মদ আলী আমাদের কে জানালো যে দাদা তার সব আসবাবপত্র মিউজিয়াম কে দান করবে কি না, দাদা সবকিছু দিতে রাজী হল আমরা আর্টিস্ট কে সব জানালাম। মোহাম্মদ আলী জানালো ২০শে জুলাই উনার আর্টের প্রদর্শনী হবে যেখানে দাদা ঝালমুড়ি বানিয়ে অতিথীদের খাওয়াবে করবে আর গান শুনাবে।
জুনের শেষের দিকে দাদা এসে বলল সে বাংলাদেশে চলে যাবে এখানে বলে রাখা ভাল দাদা আমেরিকাতে কাগজপত্র বিহীন।তিনি দুইবার উকিলের মাধ্যমে আবেদন করেছিল আমেরিকার থাকার আইনি কাগজপত্র পাওয়ার জন্য কিন্তু হাজার হাজার ডলার খরচ করে কিছুই হয় নি।গত ৩৮ বছর ধরে সে আমেরিকাতে আছে এর মধ্যে কেস চলাকালিন সময়ে সাময়িক অনুমতি নিয়ে এক মাসের জন্য বাংলাদেশে গিয়েছিল। দাদার পরিবার বাংলাদেশে থাকে উনার বউ ৩ তা ছেলে আর ২ টা মেয়ে আছে এর মধ্যে একটা ছেলে হারিয়ে গেছে।মেয়ে দুইটিকে বিয়ে দিয়েছে ।একটা মেয়ের জামাই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ,গত জুন মাসে অন্য মেয়ের জামায় টি ও মারা যায় এই কারণে উনার মন ভেঙ্গে যায় আর চিরকালের জন্য বাংলাদেশে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি চিরকাল বলছি এই কারণে উনার কাগজপত্র নাই তাই বাংলাদেশে গেলে আর আসতে পারবে না। আমি ভাবলাম দাদার বয়স এখন ৮৬ বছর যদি দাদা মারা যায় তো তার ডেড বডি পাঠাতে ও তো ৫ হাজার ডলার লাগবে তাই জীবিত দাদা কে সসম্মানে পাঠানো ভাল। আমি দাদাকে বললাম আপনি কি চান উনি বলল আমাকে একটা টিকেট কেটে পাঠিয়ে দেন।
আমি কথা বললাম আমার সংগঠনের সাথে যে দাদার বাড়ীতে তেমন কিছু নাই যদি তিনি শূন্য হাতে যায় শেষ বয়সে বিপদে হলে কি করবে।সবাই মিলে আলোচনা করে গো-ফান্ড করে টাকা তোলার সিদ্ধান্ত নিলাম ৫০০০ ডলার গোল সেট করে আমাদের বাংলদেশি সংগঠক নাইম ইসলাম কে নিয়ে বসলাম গ-ফান্ড পেইজ টি বানাতে। দাদার সাথে কথা বলে কিছু ব্যক্তিগত বিষয় জেনে নিয়ে ঝালমুড়ি দাদা লিখে গুগোল করলাম আরও কিছু জানতে। আপনারা ভাবছেন গুগোল করলাম মানে !! হা সত্যি বলছি কারণ তা ছিল সি এন এন এর বিখ্যাত অ্যান্থনি বোরডাইন এর সো তে দাদার ঝালমুড়ি দোকান ও তার বানানো ঝালমুড়ির প্রচার করেছিল। আমি ঐ ছবিটা ফান্ডপেইজ এ দিতে চেয়েছিলাম তাই গুগোল করা গুগলে দেখি এলাহি কাণ্ড বাউল দাদা ঝালমুড়ি লিখলেই অনেক পেইজ চলে আসে এশিয়ান এক ব্যান্ড তাকে ভিডিও বানিয়ে ইউটিউবে দিয়েছে। অনেক মানুষ বিভিন্ন ওয়েবসাইটে তার ঝালমুড়ির দোকান বানিয়েছে, গুগোল করে যে কেউ বাউল দাদার ঝালমুড়ির দোকানে আসতে পারে যদিও উনি রাস্তার উপর টেবিল নিয়ে ঝালমুড়ি বিক্রি করে।আমেরিকার ইয়ং ছেলে মেয়েরা আর সাদা কাস্টমার দের কাছে ঐটাই তার দোকান।তার ভক্তরা তাকে গুগলে অনেক ফিডব্যাক ও দেয় তাদের মতে কলকাতা বা বাংলাদেশের ঝালমুড়ির স্বাদ জ্যাকসন হাইটস এ পাওয়া জায়।
আমাদের ফান্ড রাইজিং পেইজ এ যখন টাকা আসতে শুরু হলো ও আর আর্টিস্ট এর শো জন্য ফেইসবুক এ ইভেন্ট পেইজ খোলা হল চারদিক থেকে সবার নজর পরল দাদার উপর। আমাদের বাংলাদেশী পত্রপত্রিকা উনাকে ইন্টার্ভিউ করল, অনেকে উনাকে সম্মান জানাতে ছুটে আসল জ্যকসন হাইটস। অনেকে আবার বদনাম বলা শুরু করল যেমন উনি লোভী বা বাংলাদেশে উনার অবস্থা ভাল উনি মিথ্যা কথা বলে আমাদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে কত কি। আমি একদিন মৌলোভীবাজার সমিতির একটি মিটিং এ যাই তাদের কাছে আবেদন করতে কিছু টাকা তুলে দিতে,তারা আমাকে কথা বলার সুযোগ দিল না। বলল পরে আসেন এখন সময় নাই আমি বললাম এখন আপনাদের সময় নাই পরে আমার সময় নাই। মনে মনে বললাম কাজী ফৌজিয়া তোমাদের কাছে আসবে না আর তোমাদের সাহায্য ছাড়াই আমি আমার গোল পুরা করব। এক নেতার সাথে তখনি অনুষ্ঠানের বাইরে কথা হল সে বলে সে মৌলবীবাজারের মানুষ হয়ে আমাদের কাছে না এসে আপনাদের ড্রামে কেন যায়। আমি বললাম সে আপনাদের কাছে ভিক্ষা চাইবে, ছোট হবে তারপর করবেন সাহায্য? আমরা তাকে কখনো ছোট হতে দিব না যা করব সম্মান করেই করব।উনার শো ছিল ২০শে জুলাই,এর এক সপ্তাহ পূর্বে আমাদের সাথী অর্গানাইজেশন ছায়া সিডিসি কল করে জানাল তারা দাদা কে তাদের বাৎসরিক অনুস্থানে এ্যাওয়ার্ড দিতে চায় আমাদের সাউথ এশিয়ান সমাজ কে ৩৮ বছর সেবা করার জন্য। আমি দাদা কে জানালাম দাদা বলল আপনি যদি বলেন আমি নিব পুরষ্কার আমি বললাম অবশ্যই নিবেন, অনুষ্ঠানের দিন কুইন্স বোরো প্রেসিডেন্ট মেলিন্দা ক্যাটজ দাদাকে পুরস্কার প্রধান করে। এর কিছুক্ষন পর নিউইইয়র্কের গভর্নর পদ পার্থী সিন্থিয়া নিক্সন দাদার সাথে দেখা করে তার হাতে বানানো ঝালমুড়ি খেয়ে তার সাথে ছবি তোলে। আমাদের ঝালমুড়ি দাদা এত কিছু জানে না কে পুরস্কার দিল কে ছবি তুলল শুধু জানে মানুষ গুলি সম্মানিত কেউ। আমি বোঝাতে গেলে আমাকে বলে তুমি আমার গার্ডিয়ান তুমি বুঝলেই চলবে। অনেক মানুষ আমাকে বলেছিল আমি ৫০০০ ডলার তুলতে পারব না কেউ বলছে উনি লোভী আমার লোভী বাউল দাদা কখনো জানতেও চায়নি কত টাকা উঠেছে ।যেদিন তিনি পুরস্কার পেলেন তার পরের দিন ৫০০০ ডলার পূর্ণ হয়েছে। দাদা কে টাকার কথা জানানোর পর উনি বলল টাকা দিয়ে আমি কি করব।
আমার দেখা বাউল দাদা কে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম জানি না আমার লিখা পড়ার পরে আমাদের গরীব ঝালমুড়ি দাদা আপনাদের সম্মান পাবে না তার নতুন কোনো মতলব আপনাদের চোখে পরবে। হসপিটাল থেকে দাদার খুব জরুরি একটা হার্টের পরিক্ষার তারিখ দিয়েছে ২০শে ডিসেম্বর আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তারপরেই উনাকে পাঠাব আশা করি আল্লাহ ততদিন উনাকে বাঁচিয়ে রাখবে বাংলাদেশের মাটিতে উনি সহি সালামতে ফিরে যাবে।
লেখক:মানবাধিকার কর্মী