
বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা:
অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে দুই বছর ধরে ভারতের আসাম রাজ্যের শিলচরে আটকে থাকা ১৪ বছর বয়সী রোহিঙ্গা কিশোরী রোজিয়া আক্তারকে ফিরে পেতে চায় বাংলাদেশে অবস্থানকারী পরিবার। কোনো স্বজন না থাকা সত্ত্বেও বৃহস্পতিবার তাঁকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে ভারত।
সামরিক অভ্যুত্থান পরবর্তী মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি কারো ফিরে আসার উপযোগী নেই দাবি করে দেশটির অভিবাসন বিভাগ আন্তর্জাতিক সীমান্তের দরজা খুলতে চায়নি বলে জানিয়েছে একাধিক ভারতীয় গণমাধ্যম।
এ তথ্যের সতত্যা নিশ্চিত করে রোজিয়া পিতা মো. জাবের আক্তার (৪৩) শুক্রবার নিউজনেক্সটবিডিকে জানান, বৃহস্পতিবার সীমান্ত থেকে ফিরিয়ে দেওয়ার পর মেয়ের সাথে মুঠোফোনে কথা হয়েছে তাঁর।
“সেখানকার কর্মকর্তারা আমার মেয়েকে জানিয়েছেন, এবার তাঁকে এখানে আমাদের কাছে পাঠানোর চেষ্টা করা হবে,” বলেন ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে এসে কক্সবাজার জেলার উখিয়ার কুতুপালংয়ের এক নম্বর ক্যাম্পের আশ্রয় নেওয়া এই শরণার্থী।
তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার অনুবিভাগের মহাপরিচালক (ডিজি) মোহাম্মাদ দেলোয়ার হোসেন নিউজনেক্সটবিডিকে বলেন, “ওই রোহিঙ্গা কিশোরীকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোই যৌক্তিক। কারণ যেখানকার মানুষ সেখানে পাঠানোই আইনসম্মত।”
“কূটনৈতিকভাবে ভারত থেকে কোনো রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে পাঠানোর প্রস্তাব দেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ তারা এখানকার নাগরিক নয়। কোনো দেশ চাইলে শরণার্থীদের এখান থেকে তাদের দেশে নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু কাউকে আমাদের এখানে পাঠাতে পারে না,” বলেন এই কর্মকর্তা।
পরিবারের বাকি ছয় সদস্যকে নিয়ে বাংলাদেশে বসবাসকারী জাবের জানান, মেয়েকে ফেরত পাওয়ার জন্য তিনি বহুবার জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) এবং বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি)কর্মকর্তাদের কাছে আবেদন জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চেয়ে কক্সবাজারে ইউএনএইচসিআর-এর মুখপাত্র লুইস ডনোভানকে ইমেইল পাঠিয়ে কোনো জবাব মেলেনি। তবে আরআরআরসি শাহ্ রেজওয়ান হায়াত নিউজনেক্সটবিডিকে বলেন, “এ ব্যাপারে আমাদের কোনো জানিয়ে লাভ নেই।”
“বিদেশ থেকে কেউ কিভাবে আসবে না আসবে সেটার জন্য ইউএনএইচসিআর-কে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সরকারের উচ্চপর্যায়ের যোগাযোগ করতে হবে,” বলেন তিনি।
“ইউএনএইচসিআর কোনো শরণার্থীকে ট্রানজিট ক্যাম্পে নিয়ে আসার পরই তাঁর কেউ এখানে আছে কিনা তা যাচাই করে দেখার সুযোগ পাই আমরা,” যোগ করেন আরআরআরসি।
কোনো অনুরোধ পায়নি বাংলাদেশ
নিউজনেক্সটবিডির কাছ থেকেই রোজিয়ার খবরটি জানার কথা উল্লেখ করেন ডিজি দেলোয়ার। ওই কিশোরীরর ব্যাপারে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক কোনো অনুরোধ পায়নি উল্লেখ করে তিনি প্রশ্ন তোলেন, “পরিবারের সাথে একত্রিক করার বিষয়টা অন্যভাবেও হতে পারে না? এখানে যারা আছে তাদের সেখানে নেওয়া যেতে পারে না?”
“বাংলাদেশের যতুটুক সামর্থ্য তার চেয়ে অনেক বেশী রোহিঙ্গাদের জন্য করেছে বাংলাদেশ। এখন অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলোরও তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত,” বলেন তিনি।
বাংলাদেশি মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন নিউজনেক্সটবিডিকে বলেন, “মাত্র ১৪ বছরের এক উদ্বাস্তু কিশোরী দুই বছর ধরে অভিভাবকহীন অবস্থায় বন্দী আছে। তাঁকে যে কোনা উপায়ে পরিবারের সাথে একত্রিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া দরকার। দুই দেশের মধ্যে আলোচনা সাপেক্ষে সেটা ভারতে বসে হোক বা বাংলাদেশে। এটাকে কোনোভাবে বাঁধাগ্রস্থ করা উচিত নয়।”
“আর কোনো অবস্থাতেই তাঁকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী বা দেশটির সামরিক সরকারের হাতে তুলে দেওয়া ঠিক হবে না,” যোগ করেন মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এই মহাসচিব।
ভারতীয় মানবাধিকার কর্মীদের কাছ থেকে খবর পেয়ে তিনি ইতোমধ্যে মেয়েটির পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেছেন জানিয়ে লিটন আরো বলেন, এই বিষয়টির আইনগত দিকগুলো খতিয়ে দেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মীরা।
পরিচয় গোপন রেখে ভারতের এক অভিবাসন কর্মকর্তা বৃহস্পতিবার হিন্দুস্তান টাইমসকে বলেন, “বর্তমানে বাবা-মা বাংলাদেশে থাকায় মেয়েটি মিয়ানমারে যেতে রাজি নয়।”
এর আগে আসাম ট্রিবিউন বুধবার এক প্রতিবেদনে জানায়, ১৪ বছর বয়সী যে রোহিঙ্গা কিশোরীকে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে নিয়ে ভারত সরকার এগিয়ে চলেছে, তাঁকে তার বাংলাদেশের কক্সবাজারে পাঠানোর অনুরোধ করা হয়েছিল, যেখানে একটি শরণার্থী শিবিরে তাঁর বাবা-মা বাস করছেন।
দু’বছর আগে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশের জন্য আটক হওয়ার পর রোজিয়া আসামের শিলচরে যে বেসরকারি সংস্থার আশ্রয়ে ছিল, সেই নিবেদিতা নারী সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা দিবা রায় রয়টার্সকে বলেছেন, তারা স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিল যে মিয়ানমারে মেয়েটির পরিবার নেই।
মেয়েটিকে স্থানীয় পুলিশে সোপর্দ করার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নির্দেশনা পেয়েছিলেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
হিন্দুস্তান টাইমস, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসসহ একাধিক ভারতীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, আসাম পুলিশের আট সদস্য বৃহস্পতিবার তাঁকে নিয়ে মণিপুর রাজ্যের একটি সীমান্ত থেকে ফিরে এসেছে।
প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হলে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী দেশের ক্ষমতা দখলের পর ভারত থেকে সেখানে ফেরত যাওয়া প্রথম রোহিঙ্গা নাগরিক হতো ওই কিশোরী। আপাতত তাঁকে শিলচরের আশ্রয় কেন্দ্রে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
ভারতে মানবাধিকার কর্মী তপন বোস ও তাঁর সাউথ এশিয়ান ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটসের সহকর্মীরা এটা নিয়ে সোচ্চার আছেন বলেন জানিয়েছেন নূর খান লিটন। ইতিমধ্যে জাতিসংঘও ওই কিশোরীকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়ায় নয়াদিল্লির সমালোচনা করেছে এবং কর্তৃপক্ষকে প্রক্রিয়াটি বন্ধ করার আহবান জানিয়েছে।
“মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিরাপদ, সুরক্ষিত এবং টেকসই পদ্ধতিতে স্বেচ্ছায় ফিরে যাওয়ার জন্য এখনও উপযুক্ত নয় এবং মিয়ানমারে ফিরিয়ে দেওয়া মাত্রই শিশুটি গুরুতর ক্ষতির ঝুঁকিতে ফেলতে পারে,” জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের এক মুখপাত্র বৃহস্পতিবার এই বক্তব্য দিয়েছেন বলে জানিয়েছে আল-জাজিরা ও রয়টার্স।
আরো যা বললেন রোজিয়ার পিতা
রোজিয়ার পিতা জাবের নিউজনেক্সটবিডিকে জানান, মিয়ানার সেনাবাহিনীন অভিযানে মুখে প্রাণ বাঁচাতে স্বপরিবারে পালিয়ে এসে এখানে আশ্রয় নিয়েছেন।
২০১৯ সালে মার্চ মাসে উখিয়ার জামতলীতে মামার কাছে বেড়াতে গিয়ে নিখোঁজ হন তাঁর বড় মেয়ে রোজিয়া। পরে জানতে পারেন, সেখান থেকে আরো কয়েকজন রোহিঙ্গার সাথে মালয়েশিয়া যাওয়ার উদ্দেশ্যে ভারতে যাত্রা করে দেশটির আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে ধরা পরেছে সে।
“এক বছর নয় মাস পেরিয়ে গেছে তাঁকে চোখে দেখছিনা। মাঝে মধ্যে ফোনে কথা হয়। জানিনা এখন আমার মেয়েটা কি হবে। খুবই চিন্তায় আছি। মেয়েকে ফেরত আনতে এখানকার দাতা সংস্থাসহ সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে অনেক ঘোরাঘুরি করছি, কোনো সুরাহা পাইনি,” বলেন জাবেন।
বাংলাদেশে আসার আগে মিয়ানমারের বুশিডংয়ের থমবাজার এলাকায় চাষবাদ করে পরিবারের সাত সদস্য নিয়ে অনেক ভালো ছিলেন বলেও জানান তিনি।