ঈয়ন’র ভাবনাংশ কিম্বা অংশের ভাব

বিধুনন জাঁ সিপাই, ঢাকা:
‘…মায়েরে ভজিলে হয় তার বাপের ঠিকানা’
লালন ফকিরের এই উচ্চারণে ‘ভজনা’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ দাঁড়ায় ‘মায়ের পূজা’। কিন্তু ফকির লালন উদ্ধৃত ‘মা’ বায়োলজিক্যাল মাতৃত্ব নিয়া চিন্তিত নয়। নারী-পুরুষের যে জৈবিক বিভেদ চর্চা জারি আছে, সে সম্পর্কে ফকির অবগত। সেদিক থেকে, সাঁইজির ‘মা’ এখানে প্রকৃতি-পুরুষের দ্বান্ধিক প্রক্রিয়ার দিকে আমাদের চিন্তাকে ধাবিত করে। পুরুষ বা কর্তা সত্ত্বা থেকে সাঁইজি প্রকৃতিকে আলাদা করেন নাই। একই কালামের পরের স্তবকের দিকে যদি আমরা নজর দেই,
‘… পুরুষ পরওয়ার দিগার/ অংগে ছিল প্রকৃতি তার’
কিন্তু এখানে সাঁইজি ব্যবহৃত ‘পুরুষ’ শব্দটি যদি আপনার কল্পনায় দাঁড়ি গোঁফ ওয়ালা কোন পেশীবহুল মানব প্রতিকৃতি নিয়ে আসে, তবে জেনে রাখুন, পুঁজিবাদের সেই লিংগবৈষম্যবাদী পুরুষ বা দানবতন্ত্রের বিরুদ্ধে নদীয়ার ভাবতাত্বিক আন্দোলন চলছে এবং চলবে। নদীয়া পুরুষকে লিঙ্গ দ্বারা বিচার করে না। পুরুষ হয়ে ওঠাই নদীয়ার ভাবতাত্ত্বিকতার মূল লক্ষ।
এত কথা বলা কেন? শরীফ খিয়াম আহমেদ ঈয়ন’র ‘ভাবনাংশ’ কাব্যগ্রন্থ’র ‘নারী’ কবিতা পাঠ করছিলাম। ঈয়ন লিখেছেন, ‘…যিনি স্রষ্টা, তিনি নারী’। ঈয়ন’র ‘নারী’ ঐতিহাসিক নির্যাতনের পথ বেয়ে পুরুষের নির্যাতন অপমান আর অবজ্ঞার ফলাফলে স্রষ্টা থেকে পতিত হয়ে ‘শ্রেষ্ঠতম সেবাদাস রুপে গড়েছেন আদমকে’ সে খবর আমরা তার কবিতায় পাই। কিন্তু কবিতার প্রায় শেষ স্তবকে পাঠকের জন্য কবি সাজিয়ে রেখেছেন ধাঁধার বলয়; নাকে পাই গন্দমের গন্ধ, আদি পাপের শব্দ শুনি এই উচ্চারণ থেকে।
‘…আজন্ম;এক বেজন্মা বোধ
তাড়া করে ফিরছে
বিতৃষ্ণা মিলছে
ক্রমাগত বাড়ছে, জন্মানোর ক্রোধ’
আমাদের এই জন্মানোর ক্রোধে উদ্ভাসিত হয়েছে নব জীবন কিন্তু সেখানে আজন্ম কাল ধরে আমরা কোন বেজন্মা বোধ নিয়া আছি? ঈয়ন কি আমাদের আদি জন্মের বোধ কে বিতৃষ্ণা বলছে? নাকি
‘…সুপ্রিম কোর্টের খোদারাও
দল বেঁধে বিব্রত হয় দেখে
বেকারত্বের ফ্রেমে বন্দী প্রেমে
সব কটাক্ষ মেনে নেই আমরাও’
ললনার ছলনা কিম্বা ছলনায় আমরা দেখি যত ললনা- ঈয়ন তাকেও দেখে অদ্ভুত দোলাময়তায়।
‘আহি হো কাহাসে
শরীরী বাহাসে
জানতাহে সাব
এ ভাব ভালো না
কেয়া কাহু ইয়ে
চতুর ছলনা…’
কিন্তু ঈয়ন নিজেকে দাবী করেন একজন ‘বিচ্ছিন্নতাপ্রিয় প্রেমিক’ হিসেবে। ‘বিক্ষুব্ধ প্রিয়তমা’কে লেখা চিঠিতে পরিলক্ষিত হয়- একজন কিশোর কতটা অনায়াসে যাবতীয় রাজনৈতিক চাপ কাঁধে নিয়ে বড় হয় তার কিশোরী প্রেমিকার সামনে। হয়ত ঈয়ন’র প্রেমিকা নিজস্ব গ্রামে একান্ত সন্তর্পনে চেয়েছে তার প্রেমিককে, স্রেফ প্রেমিকা বেশে গাঢ় আবেশে কিন্তু-
‘তৃতীয় বিশ্বের এক
কলম কামলা হয়ে-
তৈলাক্ত বৈশ্বিক ক্ষুধা,
জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ আর
ড্রোন হামলার এ যুগে
শুধু প্রেমবন্দীইবা
থাকে কি করে?’
এই প্রশ্ন রেখে চলমান ঈয়ন’র নিজস্ব পরিচয় পাই আমরা ‘আত্মকথা’ শিরোনামের কবিতায়।
‘আমি তা
যা সস্তা’
বুদ্ধিজীবী ফ্রাঁসোয়া লিওতার্দ’র তার পুঁজির বাজারে ব্যক্তিকে চিনিয়েছেন এই বলে, ‘I am what? I buy’ এই তীব্রতর গ্রাসী বাজারে আমরা প্রত্যেকেই পন্য ছাড়া অন্য কিছু না। পুঁজির নিলামে আমাদের হাসি-কান্না, উদ্বেল আবেগ কিম্বা আমাদের পুঁজির বিপক্ষবাদী লড়াই সংগ্রামও বিকিকিনি হয় দাঁড়িপাল্লার নিক্তিতে। আর এই বাজারে পেশীবহুল পুরুষকে সস্তা দামেই কিনবে বনিক সমাজ, সে বিষয়ে ঈয়ন নিশ্চিত।
পুঁজির এই মড়ক খানায় পাপের সংজ্ঞা দাঁড় করানো হয়েছে পরবর্তী জীবনের সুখের বিপরীত সংজ্ঞায়নের মাধ্যমে। এই যে পরবর্তী জীবনের ধারণার সাথে পাপ-পূন্য বোধকে নিয়া ব্যবসায়িক লেনাদেনা সে বিষয়ে ঈয়ন’র কন্ঠে আমরা শুনি ‘পাপাত্মায় শুদ্ধতার গান’।
‘পাপ না করলে, পাপবোধ কারো হয় না
পাপবোধ ছাড়া যে, শুদ্ধতা চেনা যায় না’
ঈয়ন শুদ্ধতার পথ খুঁজে পান পাপকে চেনার মাধ্যমে। সত্য এই যে, বিপরীতার্থকতা না থাকলে আলোটা জ্বলে না। বস্তুর ক্রিয়া বোঝা যাবে তখনই, যখন তার প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। অস্বীকারের মধ্য দিয়ে আসলে আমরা স্বীকৃতির থেকে দূরে সরে যাই। শয়তান কে স্বীকৃতি না দিলে আমরা ঈশ্বর থেকে দূরে সরে যাবো; কেননা আপনি যখন মহামহিম ঈশ্বরকে প্রবল ক্ষমতাশালী এবং সকল ক্রিয়ার কর্তা মান্য করছেন সেহেতু আপনাকে এও স্বীকার করতে হয় যে, শয়তান ঈশ্বরের আশ্রয় বহির্ভূত কোন ঘটনা নয়।
‘…কে’বা করে
অস্বীকার
আপনার
অবদান
অসুর বা
লুসিফর
যে রুপেই
ফরমান
লাভ ইউ,
হে মহান
শয়তান।’
নিউজনেক্সটবিডি ডটকম/বিজাঁসি/এসকেএস/টিএস