
রহিম আব্দুর রহিম:
জাতির ক্রান্তিকালের কান্ডারী, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোভিডকালীন নিন্দুকের কাছেও পরম নন্দিত। তাঁর সরকার এ যাবৎ কোভিড-১৯ কালীন চিকিৎসা সেবার জন্য জরুরী ভিত্তিতে ২ হাজার ডাক্তার, ৫ হাজার নার্স নিয়োগ দিয়েছেন। অসহায় ঘরবন্দি মানুষের জন্য,চাল ১ লক্ষ ৬২ হাজার ৮শত ৬৭ মেট্রিকটন। নগদ ৯১ কোটি ৪৭ লক্ষ ৭২ হাজার টাকা। ১০ টাকা কেজি দরে বিক্রির জন্য ৮০ হাজার মেট্রিকটন চাল বরাদ্ধ দিয়েছেন। মে মাসে দরিদ্র পরিবারের জন্য অতিরিক্ত ৫০ লক্ষ কার্ড বিতরণ করা হয়েছে;যার মাধ্যমে এই চাল কার্ডধারী কিনতে পারবেন। কাজ হারিয়েছেন,কিন্তু সহায়তা কর্মসূচির আওয়াতায় নয়;এধরনের ৫০ লক্ষ পরিবারকে ২,৫০০ টাকা করে মোট ১২‘শ ৫০ কোটি টাকা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে। কওমি মাদ্রাসার ছাত্র শিক্ষকদের জন্য দু‘দফায় প্রায় ১৮ কোটি টাকা প্রদান করেছেন। সারা দেশের মসজিদের ইমাম মুয়াজ্জিনদের জন্য ১২২ কোটি ২ লক্ষ ১৫ হাজার টাকা সহায়তা দিয়েছেন। অর্থনৈতিক কর্মকান্ড এবং উৎপাদন ব্যবস্থাকে পুনরায় সচল করতে,১ লক্ষ ১ হাজার ১১৭ কোটি টাকার প্রনোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। রপ্তানীমুখী শিল্প,ক্ষুদ্র-মাঝারি ও কুটির শিল্প,কৃষি,মৎসচাষ,হাস-মুরগী ও পশুপালন খাতসহ ১৮ টি অর্থনৈতিক খাতকে এসব প্রনোদনা প্যাকেজের আওতায় আনা হয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক এবং পল্লিকর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনকে ৫০০ কোটি টাকা করে সর্বমোট ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে। এই তথ্য প্রধানমন্ত্রী ২৪ মে,জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে তুলে ধরেছেন বলে, আমাকে জানিয়েছেন,আওয়ামীলীগ ¯্রােতের বিপরীত ঘরোনার চিরনিন্দুক আমার এক সহকর্মী। তিনি একটি মাদ্রাসার প্রভাষক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার,এ ধরনের কর্মকান্ডে তিনি শ্রদ্ধা নিবেদন করে জানিয়েছেন,‘প্রায় একযুগ পার হলো,প্রভাষকই থেকে গেলাম,কি এক আনুপাতিক আপদ এসে কর্মজীবনের সম্মানটুকু পরিপূর্ণ হতে দিচ্ছে না।’ আমি নিজেও একজন একই আপদে আটকে আছি। অথচ আমার শিক্ষার্থীরাই সহকারি অধ্যাপক,অধ্যাপক হওয়ার সম্মান অর্জন করায় আমি এবং আমরা আদু ভাইয়ের গ্লাণি বয়েই বেড়াচ্ছি। তবে সকলের প্রধানমন্ত্রীর কোভিডকালীন নির্দেশনা,‘দল মতের উর্দ্ধে থেকে ত্রাণ বিতরণে’র ঘোষণা লুফে নিয়ে,তৃণমূল পর্যায়ের বিরোধী ঘরোনার বন্ধুরা জোট বেঁধে প্রতিবাদি হওয়ায়,আবুল মনসুরের ‘রিলিফ ওয়ার্ক’ প্রবন্ধের সহজ-সরল কোমল হৃদয়ের হামিদের খেদ দূর করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা,দল-মতের উর্দ্ধে জায়গা করে নিলেন।
এতো গেল সকলের প্রধানমন্ত্রী’র করোনাকালীন বীরত্বগাঁথা। খ্যাতির মাঝে অখ্যাতদের ডায়রিতে যাওয়ার আগে স্মরণীয়, মানবতায় কণ্ঠ উজাড় করেছিলেন ভূপেন হাজারিকা,গেয়েছিলেন ,“মানুষ মানুষের জন্য,জীবন জীবনের জন্য ।” রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী, গবেষক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব প্রফেসর সানজীদা খাতুন, তাঁর লেখা মাদার তেরেসা প্রবন্ধটির শুরুতে বলেছেন,“মানুষ মানুষকে ভালোবাসবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু সব সময় তেমনি দেখা যায় না । আবার বিভিন্ন যুগে এমন মানুষও পৃথিবীতে আসেন,যাঁরা মানুষের সেবাতেই প্রাণমন সব ঢেলে দেন। ভালোবাসা দিয়ে তাঁরা জয় করে নেন দুনিয়া । মাদার তেরেসা ছিলেন তেমনি একজন অসাধারণ মানব দরদী ।” মাদার তেরেসা মানব কল্যাণে যা করেছেন,তা পৃথিবীর মানবতায় যেভাবে স্থান পেয়েছে,তার বিকল্প পৃথিবীতে হয়তবা সৃষ্টি হবে না । তবে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে,তাঁর শত-সহস্র অনুসারি যে রয়েছেন;এতে কোনো সন্দেহ নেই ।

২০২০ সালের ৮মার্চ তাঁর এক অনুসারির আবির্ভাব ঘটেছে নারায়নগঞ্জ সিটিতে । সারা পৃৃথিবী কোভিড-১৯ এর আতঙ্ক স্থবির । স্ত্রী তার স্বামীকে,মা তার সন্তানকে,পুত্র তার মাকে দুরে সরিয়ে দিয়েছেন। সুদিনের বন্ধুরা বহুদিনের মিত্রের বন্ধন ত্যাগ করে সভ্যতার চাকা বিকল করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন । এমন খবর প্রকাশ হচ্ছে বারবার । কোভিড-১৯’কে প্রকৃতি ও পরিবেশবাদীরা প্রকৃতির প্রতিশোধ হিসেবে দেখছেন। গ্রাম পর্যায়ের খেঁটে খাওয়া মানুষরা দেখছেন,ড্যামকেয়ার হিসাবে। উন্নত বিশ্বের মাথা মোটারা দেখছেন, এটা কোনো দেশের আবিষ্কার হিসাবে। আত্মশক্তিতে বলিয়ান মহান মানুষরা দেখছেন,“ঝড়-ঝঞ্ছা মহামারি আসবে। সেগুলো মোকাবিলা করেই আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রয়োজন জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্ঠা। সংকট যতই গভীরই হোক,জনগণ ঐকবদ্ধ থাকলে তা উৎড়ানো কোনো কঠিন কাজ নয়।”-(শেখ হাসিনা ২৪ মে সন্ধা ৭:৩০ মিনিট,জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণ)। ২০২০ সালের ৮ মার্চ একটি সংবাদ প্রচার হয় বিভিন্ন মিডিয়ায়,যার শিরোনাম ছিল,‘নরায়নগঞ্জে ইতালি ফেরৎ দুই প্রবাসী করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু। এরপর সারা নারায়নগঞ্জ করোনা আতঙ্কের শহরে পরিনত হয়। জ্বর-সর্দি হলেই ধারে কাছে যাচ্ছেনা মানুষজন। দেশের অনেক জায়গার সেবকরা পালিয়েছিলেন সেবা কেন্দ্র থেকে। দুরাবস্থা, দুর্দিন-দুঃসময়ে আবির্ভাব ঘটে মাকছুুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ নামের এক জনসেবকের। যে সেবকরা জন মানুষের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত। ভোটের আগে যাঁরা,লিফলেট-পোস্টার,ব্যানার সেঁটেছিল হরেক রকম বিশেষণ,‘গরিবের বন্ধু,জন দরদী,নিস্বার্থ সমাজসেবী অমুক কিংবা তমুক।’ দুর্দিনে কেউ সরাসরি মাঠে নেই। ওই সময় আবুল মনসুর আহমদ এর ব্যাঙ্গাত্মক প্রবন্ধ ‘জনসেবা য়ুনিভার্সিটি’র ভন্ড সেবক ইয়াকুবকে পায়ে মাড়িয়ে পৃথিবীর সকল জনসেবকদের সম্মান রক্ষা করলেন, নারায়নগঞ্জের খোরশেদ আলম।
কোভিড-১৯ দলনিরপেক্ষ এক অতিথি ঘাতক। ডাক্তার,পুলিশ,এমপি-চেয়ারম্যান,ধনী-দরিদ্র কাউকে কেয়ার করছে না। সঙ্গত কারণেই অনেকেই বাঁচার তাগিদে গা ঢাকা দিয়েছেন। গা ঢাকা দেয়নি শুধু সময়ের সাহসী সন্তানরা। এই সন্তানদের মধ্যে ‘হিরো অফ দা কোভিড-নাইনটিন খোরশেদ আলম অন্যতম।’ তিনি পৃথিবীর জন দরদী জনসেবকদের প্রতিনিধিত্বকারী বিশ^ মডেল স্বরূপ। যিনি প্রতিষ্ঠা করেলেন,অমর বাণী ‘কুকুরের মত হাজার বছর বেঁচে থাকার চেয়ে সিংহের মত এক সেকেন্ড বেঁচে থাকা অনেক ভালো।’ সেবক সমাজের মাইলস্টোন, ‘হিরো অফ দা কোভিড নাইনটিন খোরশেদ আলম,’ ১৯৭৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর নারায়নগঞ্জ সিটির কালিরবাজার নামক স্থানে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা,আলহাজ¦ শাহ আলম খন্দকার ও মাতা বেগম রোকেয়া খন্দকার মারা গেছেন। তিন বোন,তিন ভাইয়ের মধ্যে আলম সবার ছোট। তিনি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পাশ করেছেন নারায়নগঞ্জ আদর্শ বিদ্যালয় থেকে।

ওই বিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৯০ সনে এস এস সি,নারায়নগঞ্জ তোলারাম সরকারি কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয় থেকে ১৯৯২-সালে এইস এস সি এবং ১৯৯৪ সালে একই কলেজ থেকে বিয়ে পাশ করেন। ২০০৩ এর ২৫ মে আলম’ আফরোজা খন্দকার লুনা নামের এক মেয়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ‘কোভিড হিরো’ দুই সন্তানের জনক। বড় ছেলে নাকিব খন্দকার,নারায়নগঞ্জ আদর্শ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র। মেয়ে নাবিলা খন্দকার একই বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। খোরশেদ আলম যেভাবে ‘কোভিড হিরো’ হলেন। চলতি বছর (২০২০) ৮ মার্চ,ইতালি ফেরৎ নারায়নগঞ্জের দুই অধিবাসি কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এই সংবাদ বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচার হওয়ার পর নারায়নগঞ্জ সিটির ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের নিবার্চিত কমিশনার মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ সেবার ব্রত নিয়ে এগিয়ে আসেন। গঠন করেন কোভিড-১৯ টিম। প্রথম দিনই ২০ হাজার লিফলেট ছাঁপিয়ে কোভিডকালীন গণসচেতনতায় মাঠ দখলে নেন। মাইকিং,অনলাইন প্রচার ছাড়াও তিনি লিফলেট বিতরণ শুরু করেন। তাঁদের দলের মহৎ কাজটি হলো,কোভিড-১৯ আক্রান্ত মৃত ব্যক্তিদের দাফন ও সৎকারের কাজ সম্পন্ন করা। যেখানেই,রোগী সেখানেই খোরশেদ আলমের টিম ও তাঁর পদচারণা। খোকন সাহা নামের এক হিন্দু ভদ্র লোক মারা যাওয়ার পর,তার স্ত্রী,মা এবং সন্তানরা ছাড়া সবাই দূরে সরে যান। ওই মুহূর্তে মৃত ব্যক্তির মুখাগ্নী তাকেই করতে হয়েছে।
এই সংবাদ মিডিয়ায় আসলে খোরশেদ দেশ বিদেশে পরিচিত হয়ে ওঠেন । এযাবৎ তাঁর দল ৫৫ টি মৃত লাশের দাফন-সৎকার করেছেন। এর মধ্যে ১৮টি কোভিড-১৯ পজেটিভ,৭ টি স্বাভাবিক,বাকিরা কোভিড-১৯ উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু। তাঁর এই কর্মের শুরুতে যখন স্যানিটাইজারের অভাব দেখা দেয়, ওই সময় তাঁর স্ত্রী আফরোজা খন্দকার লুনা,দুই সন্তান নাকিব ও নাবিলা খন্দকার মিলে, ৫০এম এল এর কয়েক হাজার স্যানিটাইজার তৈয়ার,বোতলজাত ও বিতরণ করেন। খোরশেদ আলমে’র স্ত্রী কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হওয়ার পর,তাঁকে তাঁর বাসায় আইসোলেশনে রেখে,দুই সন্তান,খোরশেদ আলম এবং তার টিম দিন-রাত কল্যাণে কাজ করছেন। দেশে যখন কোভিড-১৯এর চাউর শুরু হয়,তখন থেকেই তিনি তাঁর নিজ ওয়ার্ডের বিভিন্ন মোড়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা,সড়কে ,ঘরে,প্রতিবেশ পরিবেশে জীবানুনাশক স্প্রেকরণ,যানবাহন জীবানুমুক্তসহ সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখতে পাড়া-মহল্লায় আড্ডা বন্ধে অনুরোধ বাণী প্রচার,ওয়ার্ডবাসীর স্বাস্ব্যসেবা ও পরামর্শে চিকিৎসকদের নিয়ে টেলিমেডিসিন সেবা চালু,যেখানেই করোনা রোগীর লাশ,সেখানেই এগিয়ে যাচ্ছেন খোরশেদ আলমের টিম কোভিড-১৯।
নারায়নগঞ্জের যেখানেই মানুষ মারা যাচ্ছেন, সেখানেই তাঁর টিমের ডাক পড়ছে। মানুষের ভরসা তাঁর উপর। তিনি এখন মুকুট বিহীন সম্রাট। তাঁকে আর জন প্রতিনিধি হয়ে মানুষের সেবা করতে হবে এমনটি কেউ মনে করছেন না। খোরশেদ,নিজ গুণে ‘হিরো অফ দা কোভিড নাইনটিনে’ পরিণত হলেন। ‘কোভিড নাইনটিন হিরো খোরশেদ’ এবং আমাদের কর্মজীবনের সম্মাননা স্বীকৃতি রয়ে গেল সকলের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারই হাতে।
