
সুমন তানভীর, ঢাকা,
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে বির্তক বহুৎ পুরোনো, কালে-ভাদ্রে সুযোগ পেলেই চায়ের টেবিল গরম হয় শুধু এই টপিকে। তবে এই বির্তকের সমাধান মেলা দায়। ক্ষেত্র বিশেষে অনেকক্ষেত্রেই গণমাধ্যম স্বাধীনতার পরিচয় দিলেও এর প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে অনেক। গণমাধ্যমের এই বিতর্ক চলছে যুগের পর যুগ, মিলছেনা কোনো সমাধান। তবে এই সুযোগে গণমাধ্যম যারা পরিচালনা করছেন তারা বহাল তবিয়তে একধরণের স্বাধীনতা চর্চা করে যাচ্ছেন। কারো কাছে কোনো জবাবদিহিতা ছাড়াই ইচ্ছামতো চালাচ্ছেন তাদের প্রতিষ্ঠান। বেতন স্কেল, ভাতা, ইনক্রিমেন্টের ব্যাপারে নিচ্ছেন ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত। সরকার ওয়েজ বোর্ড গঠন করে সংবাদকর্মীদের জন্য বেতনের একটি কাঠামো তৈরি করে দিলেও মানছেন না অধিকাংশই।
বর্তমানে দেশে মোট ৩০টি বেসরকারি টেলিভিশন চালু রয়েছে। সরকারি বিজ্ঞাপন তালিকাভুক্ত জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকার সংখ্যা ৭০৭টি। সেইসঙ্গে ২৬টি বেসরকারি রেডিও তাদের সম্প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এই সবগুলো মিলেই হয় গণমাধ্যম শিল্প। অথচ এ শিল্পের কারও সাথে কারও বেতন কাঠামোর কোনো সমন্বয় নেই। যে যার মতো বেতন স্কেল ঠিক করছেন, বেশীরভাগ প্রতিষ্ঠানই দিচ্ছে না ইনক্রিমেন্ট, যদিও দুই একটি প্রতিষ্ঠান দিচ্ছেন সেটাও কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে। উৎসব ভাতার বেলায়ও দেখা যাচ্ছে একই চিত্র। কিছু প্রতিষ্ঠান আবার মাসের পর মাস চলে গেলেও বেতন-ভাতার নাম নিচ্ছে না। ভাবটা এমন, তারা বেতন দিচ্ছে সেটাই বেশী। অথচ জাতীয় ও আন্তজার্তিক প্রায় সব আইনে শ্রমিকদের সঠিক মুজুরি পরিশোধের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
এক্ষেত্রে সংবাদ শ্রমিকদের জন্য রয়েছে আলাদা বেতন কাঠামো। গত ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯ সংবাদকর্মীদের বেতন অস্টম ওয়েজবোর্ডের চেয়ে বিভিন্ন গ্রেডে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ বাড়িয়ে নবম ওয়েজবোর্ডের গ্রেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। অথচ বিভিন্ন অজুহাতে এর কিছুই মানছেন না সংবাদ ব্যবসায়ীরা। যার ফল ভোগ করতে হচ্ছে সাংবাদিকদের। প্রতিবাদ করলেই হারাতে হচ্ছে চাকরি। অথচ এরকিছুই প্রকাশ্যে আসছেনা। গার্মেন্টেসে বেতন ভাতা না দিলেই শ্রমিকরা বিক্ষোভে নামেন, রাস্তা অবরোধ করেন। সেই বিক্ষোভ যারা কাভার করেন একই দাবিতে তাদের বিক্ষোভগুলো মনের মধ্যেই চাপা পড়ে যায়। চোখ-কান বুজে গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন আদায়ে সোচ্চার থাকেন তারা, অথচ নিজের বাসার চাল আর সন্তানের দুধের টাকার কষ্টের কথা জানাতে পারেন না কাউকে।

আমার পরিচিত একটা হাউসের কথায় ধরা যাক, সঙ্গত কারণেই নাম বলা যাচ্ছে না। রঙ্গিন পর্দার এই টেলিভিশনটিতে বছরে তিন চারবার বেতন হয়, সেটাও কবে হবে তা কেউ বলতে পারেন না। এমনকি, সে কথাটা জিজ্ঞেসও করা যাবে না, মৌখিকভাবে এমন নির্দেশনা দেওয়া আছে। আমারই খুব ঘনিষ্ঠ একজনকে জিজ্ঞেস করার কারণে চাকরিও হারাতে হয়েছে। বেশীরভাগ স্টেশনের ছাঁটাইয়ের পদ্ধতিটাও অভিনব। শ্রম আইনকে পাশ কাটানোর কৌশল হিসেবে কর্মচারীকে মৌখিকভাবে বাধ্য করা হয় লিখিতভাবে অব্যাহতি দিতে। কারণ নিজেরা তার কোন শ্রমিককে বিনা অপরাধে ছাঁটাই করলে আইনের মারপেচে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। সেইসঙ্গে পাওনা হিসেবে দিতে হয় একটা বড় অর্থ। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ (২০১৩ সালের সংশোধনীসহ)- এর ধারা ২৬এ বলা হয়েছে, কোনো প্রতিষ্ঠান চাইলে তার অধীনস্ত শ্রমিককে টার্মিনেট বা ছাঁটাই করতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে ১২০ দিন আগে উক্ত শ্রমিককে প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্তের বিষয়টি জানিয়ে দিতে হবে। সেইসঙ্গে, ছাঁটাই তালিকায় নাম ওঠা শ্রমিকদের কর্মদিবস হিসেবে তাকে গ্রাচুইটি দিতে হবে। অর্থাৎ, কোন শ্রমিক যদি উক্ত প্রতিষ্ঠানে ১০ বছর চাকরি করেন তবে বছর হিসেবে তাকে ১০ মাসের বেতন দিয়ে দিতে হবে। তবে কোনো শ্রমিকের যদি চাকরির বয়স সংক্ষিপ্ত হয় তবে তাকে অন্তত চারমাসের অগ্রীম বেতন দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেইসঙ্গে বকেয়া, ওভারটাইমের জন্য কোনো পাওনা, অর্জিত ছুটি ভোগ না করে থাকলে সমুদয় অর্থ, নিয়োগকর্তার শর্ত মোতাবেক বোনাস বা অন্যকোনো পাওনা, ভবিষ্যত তহবিল ও লভ্যাংশ থেকেও (যদি থাকে) পাওনা অর্থ চাকরি হারানোর পরবর্তী এক মাসের মধ্যে পরিশোধ করে দিতে হবে।
তবে গণমাধ্যম শিল্পে এসব নিয়ম-কানুন অনেকাংশেই আকাশ-কুসুম। কোনো মালিকই এসব নিয়মের ধার ধারছেন না। বেশীরভাগ ছাঁটাইয়ের বেলায় সংবাদকর্মীকে বাধ্য করা হয় চাকরি থেকে অব্যাহতি নিতে। যেমন খুব সম্প্রতি দেশের লিডিং একটি ইংরেজী পত্রিকার ছাঁটাইয়ের ভাষা শুনলে যে কেউ শিহরিত হবে। ”১৯ আগস্টের মধ্যে পদত্যাগ করতে চান নাকি চাকরিচ্যুত হতে চান?” এই ছিলো তাদের ভাষা। তাও সেটা জানানো হয় মাত্র দুইদিন আগে অর্থাৎ ১৭ আগষ্ট। পত্রিকাটির সংবাদকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ পর্যন্ত প্রায় ৩৫ জনকে ছাঁটাই করা হয়েছে। বাকিদের মধ্যে বিরাজ করছে চরম আতঙ্ক। শুধু এই ইংরেজী দৈনিকই নয় করোনা মহামারির দোহাই দিয়ে একই রাস্তায় হাঁটছে দেশের অন্যতম শীর্ষ আরেক বাংলা দৈনিক পত্রিকা। যারা নিজেদেরকে নাম্বার ওয়ান পত্রিকা হিসেবে দাবী করে। পাঠক বিচারেও দাবিটা অমূলক নয়। যতোদূর জানা গেছে, আট মাসের অগ্রীম বেতন দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির অনেক কর্মীকেই তারা ইতিমধ্যে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করেছেন, যাদের বেশীরভাগই প্রতিষ্ঠানটিতে প্রায় ১০-১২ বছর ধরে চাকরি করেন। একরারে জন্যও ভাবা হয়নি, এই করোনাকালে মানুষগুলো কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন? কে তাদের চাকরি দিবে।

অথচ, এই মানুষগুলোর মেধা ও মননকে পুঁজি করে পত্রিকাটি দেশের নম্বর ওয়ান পত্রিকা হিসেবে জনস্বীকৃতি পেয়েছে, অথচ পেছনের সেই কারিগরদের জীবনই আজ অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়া হলো। আর এতো বড় অমানবিক কাজের জন্য কারও কাছে কোনো জবাবদিহিতা করতে হয়নি তাদের। এমনকি, কোনো পত্রিকা কিংবা মিডিয়ায় কোনো নিউজও হয়নি এ বিষয়ে। অথচ দেশের অন্যকোনো শিল্প মালিকরা যদি এ ধরণের কোনো পদক্ষেপে যেতো তবে চিল্লানো শুরু করতো এইসব ’নীতিবান’ গণমাধ্যমই । নানারকম সমালোচনার তীরে বিপর্যস্ত করে তোলা হতো সংশ্লিস্ট শিল্পের নীতি নির্ধারকদের। অথচ নিজেদের বেলায় সাতখুন মাফ। কোনো রকম জবাবদিহাতার বালাই এখানে নাই। সাংবাদিকদের দেখ-ভাল করার জন্য অনেকগুলো সংগঠন থাকলেও এসব ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা অনেকটা দায়ছাড়া মতো। কিছু সংগঠন সক্রিয়ভাবে সংবাদকর্মীদের পাশে দাঁড়ালেও খুব একটা তোয়াক্কা করেন না প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা। এভাবে সংবাদকর্মীদের জীবনকে দুঃবিসহ করে তুলছেন ’মিডিয়া জায়ান্টরা’। ভোগ করছেন পুরোদস্তুর স্বাধীনতা! করোনা মহামারীতে বেতন প্রায় অর্ধেকে নেমে আসা এক সহকর্মীর প্রশ্নটি তাই সবসময় কানে বাজে, ”প্রতিষ্ঠান যখন ব্যাপক লাভে থাকে তখনতো তার লভ্যাংশ পায় না সংবাদকর্মীরা, তবে কিছুসময় লসে থাকলে তার ফল কেনো সংবাদকর্মীদের ভোগ করতে হবে”? এ প্রশ্নের উত্তর জানা নেই কারো.
