
মিশুক মনির, ঢাবি: রাজধানীর ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। সময় সাতটা বেজে পাঁচ মিনিট। পূজা মন্ডপে হাজারো সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বলছে। পূজার ঘন্টা ধ্বনিতে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে চারপাশ। হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব শ্রীশ্রী কালী বা শ্যামাপূজা উপলক্ষে ঢাকেশ্বরীর প্রাঙ্গণে একটা উৎসব মুখর পরিবেশ বিরাজ করে।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীর লোকজন আসছেন প্রার্থণা সেড়ে প্রিয়জনদের সঙ্গে নিয়ে ছবি তুলছেন। প্রেমিকার হাতে সন্ধ্যা প্রদীপ তুলে দিয়ে প্রেমিক ছবি তুলছেন। মা দুর্গার বেশে আসা প্রেমিকার হাত ধরে ঘুরছেন মন্দিরের চারপাশ ঘুরে দেখছেন অনেক প্রেমিক।
এমন সময় কোথা থেকে যেনো একটা বিচ্ছেদের সুর ভেসে আসছে। খুঁজতে গিয়ে দেখা মিলল ৮০ বছর বয়সী এক নারীর। তার নাম পূষ্পমালা। মন্দিরের পুকুরে ঘাটের এক পাশে মন্দিরা বাজিয়ে কীর্তনের গান গাচ্ছেন তিনি সহ আরো দু’জন। কি সকরুণ সুর তার গলায়! তার গান শুনে চোখের পানি চিকচিক করে তার সামনে বসা কয়েকজন লোকের। টলোমলো অশ্রুকণায় বিচ্ছেদের গান গেয়ে আশেপাশের সবাইকে মুগ্ধ করছেন পূষ্পমালা।
পূষ্পমালা গেয়ে শোনান কীর্তনের এই গান গুলো। অনেক সাধের, পরাণ বঁধুয়া, নয়ানে লুকায়ে থোব/অন্তরে জানিয়া নিজ অপরাধ| করজোড়ে মাধব মাগে পরসাদ| নয়নে গরয়ে লোর গদগদ বাণী/আওল যৌবন শৈশব গেল। চরণচপলতা লোচন লেল।
অনেকেই বসে এক মনে পূষ্পমালার গান শুনছেন। কারো দয়া হলে কিছু টাকা দিয়ে পূষ্পমালার আশীর্বাদ নিয়ে বিদায় নিচ্ছেন। পূষ্পমালাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে কত ব্যাথা বুকের মাঝে লুকিয়ে তিনি গান গাচ্ছেন। তার সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে গেলে তিনি প্রথমে কথা বলতে রাজি হন না। সাংবাদিক পরিচয়ে কথা বলতেই তিনি তার জীবনের গল্প বলতে শুরু করেন।
মনে পড়ে যায় কবিতার দু’লাইন যা তার জীবনের সঙ্গে মিশে আছে। যেখানে যাহারে জড়ায়ে ধরেছি সেই চলে গেছে ছাড়ি/শত কাফনের শত কবরের অঙ্ক হৃদয়ে আঁকি।
তিনি বলেন, ‘বিয়ের দুই বছর পর স্বামী মইরা গেল। আমি একা অইয়া গেলামরে বাবা। একটা পোলা ওরেই বুকে নিয়া চলতে থাকি। পোলাডা বড় হইল। ভালই চলতাছিল আমার জীবন। পুরা কপাল আমার কয়েকবছর পর পোলাডাও মইরা গেল। আমার টাকা পয়সা আমার রান্না করা খাবার খাওয়ার কেউ রইল না। কার লাইগা কি করমু। এ দুনিয়ায় একা হয়ে গেলামরে বাবা। এখন আমার এই দুনিয়ায় কেউই নাই। আজকে যদি মইরা যাইয়া কাল অইব দুইদিন। আমারে দেহার লাইগা কেউ আইব না।’
কথা বলতে বলতে তার গলা ধরে আসছিল। চোখের পানি মুছে তিনি বলেন, ‘আমার কোন কষ্ট নাই! জীবনের জয় গান গাই। এহন গানই আমার সঙ্গের সাথী।’ পূষ্পমালার সঙ্গে দূর্গা রাণীও থাকেন। একই এলাকার তারা দু’জন। স্বামী হারা দূর্গা রানী দুই সন্তান নিয়ে ভালভাবেই দিন যাপন করে বলে জানান।
জীবনের হাঁটে বিক্রি হয়ে গেছে স্বামী-পুত্র। এখন পূষ্প মালা এই দুনিয়ায় একাই। গানই এখন তার সঙ্গের সাথী। সব হারিয়ে গানকে পুঁজি করেই চলে তার সংসার। নারায়ণগঞ্জের আগ্রাণগর এলাকায় তার বাড়ি। নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার মন্দির গুলোতে হিন্দু ধর্মের যেখানেই কোনো অনুষ্ঠান হয় খবর পেলে ছুটে যান সেসব জায়গায়। কীর্তনের গান গেয়ে মুগ্ধ করে মন্দিরে আসা লোকজনদের। জীবনে তিনি উচ্চাকাঙ্খা পোষন করেন না। জীবন এখন যেভাবে চলছে এভাবে চলতে পারলেই তার চলবে। এই ভবঘুরে জীবনে সে এখন আর সুন্দর করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে না। বৈঠাবিহীন নৌকার মত জীবনে সে জানে না তার গন্তব্য কোথায়।
এর আগে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনায় সহস্র প্রদীপ জ্বালানো হয়। এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান চলছে। উদ্বোধন করেন সেক্টর কমান্ডার সি আর দত্ত। প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা।
সম্পাদনা: সজিব ঘোষ