
ঢাকা: দ্বিজেন টুডু একজন ভূমিপুত্রের নাম। যিনি নিজ ভূমে পরবাসী হতে একদমই নারাজ। বাপ-দাদার জমি নিজের রক্ত দিয়ে হলেও রক্ষা করবেন এমনটাই প্রতিজ্ঞা তার। তাই তো সেদিন মাদারপুরের সাঁওতাল পল্লীতে যখন হামলা করা হলো, তখন ভয় না পেয়ে খালি হাতেই সামনের দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন।
পুলিশের ছররা গুলিতে দ্বিজেনের বাম চোখটি নষ্ট হয়ে গেছে, ডান চোখেও ঝাপসা দেখছেন। সারা শরীরে গুলির দাগ, জ্বালা-পোড়া নিয়ে পড়ে আছেন জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের ৪২৬ নম্বর ওয়ার্ডে। কি ঘটেছিল ৬ নভেম্বর, কেন তাকে হাসাপাতালের বেডে কাতরাতে হচ্ছে? এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই নিউজনেক্সটবিডি ডটকম এর সংবাদকর্মী প্রীতম সাহা সুদীপ কথা বলেছেন দ্বিজেন টুডুর সাথে।
কেমন আছেন?
দ্বিজেন টুডু: ভালো না। সারা শরীরে ছররা গুলি লাগায় বিভিন্ন অংশে প্রচণ্ড ব্যথা। উঠে বসতে প্রচুর কষ্ট হয়। বাম চোখটা নষ্ট হয়ে গেছে মনে হয়। ডান চোখের উপরে অনেকগুলো ছররা গুলি লাগায় এ চোখেও ঝাপসা দেখি। ডানচোখটাও যদি নষ্ট হয়ে যায় তাহলে সংসারে দুর্ভোগ নেমে আসবে (বলেই কেঁদে উঠেন) ।
পরিবারে কে কে আছে?
দ্বিজেন টুডু: বৃদ্ধ মা-বাবা, স্ত্রী আর তিন ছেলে নিয়েই আমার সংসার। স্ত্রীর নাম অলিবিয়া হেমব্রম। বড় ছেলে ইলিয় টুডু চতুর্থ শ্রেণিতে ও মেজ ছেলে মার্ফিলি টুডু দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। আর ছোট ছেলে জিসায়েল টুডুর বয়স মাত্র আড়াই বছর।
পুরো সংসারে আমি একাই উপার্জনক্ষম ব্যক্তি, আমি ছাড়া এমন কেউই নেই যে কাজ করে ঘরে এক মুঠো চাল আনবে। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন আমাকে সুস্থ করে তোলেন, যাতে আগের মতো কাজ করতে পারি, পরিবারের সবার মুখে ভাত তুলে দিতে পারি।
কি ঘটেছিল সে দিন?
দ্বিজেন টুডু: সেদিন (৬ নভেম্বর) সকাল ১০টায় মাদারপুরের চারটি গ্রামের সাঁওতালদের ওপর অতর্কিত হামলা হয়। এ সময় গ্রামবাসীরা আতঙ্কে ছোটাছুটি করতে থাকে। অনেকেই পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আমি না পালিয়ে খালি হাতে হামলাকারীদের দিকে এগিয়ে যাই। কিছু দূর যাওয়ার পরই বৃষ্টির মতো গুলি এসে আমার শরীরে লাগে। মাথায় আর দুই চোখে গুলি লাগার পর আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। তখন অচেতন অবস্থায় এক সাঁওতাল কিশোর এসে আমাকে উদ্ধার করে পরিবারের কাছে নিয়ে যায়। সেখান থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় আমাকে প্রথমে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট, পরে পার্বতীপুরে নেয়া হয়। শেষে রাত ১০টার দিকে নেয়া হয় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে পুলিশ এসে আমাকে গ্রেফতার করে। এরপর তিনজন পুলিশকে দিয়ে আমাকে ঢাকায় পাঠানো হয়। ওরা আমাদের মারলো, গুলি করলো, ঘর-বাড়ি আগুনে পোড়ালো আবার মামলার আসামিও আমাদেরই করলো।
ওই ঘটনার জন্য কাদের দায়ি করবেন?
দ্বিজেন টুডু: সাপমারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাকিল আলম বুলবুল আমাদের জমি উদ্ধারের আশ্বাস দিয়েছিল। বড় আশা করে তাকে ভোট দিয়ে চেয়ারম্যান বানিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম বাপ দাদার জমি ফেরত পাবো। গোবিন্দগঞ্জের এমপি আবুল কালাম আজাদ ও চেয়ারম্যান বুলবুলের কথায়ই আমরা জমি উদ্ধারের আন্দোলনে নেমেছিলাম, ঢাকায় গিয়ে মানববন্ধনও করেছিলাম। আন্দোলনে নামিয়ে তারাই এখন আমাদের মারলো। ৬ নভেম্বর বাগদা ফার্মের পাশে কাটার মোড় এলাকায় চিনিকলের সামনে অবস্থান নিলে চিনিকলের এমডি এসে আমাদের আশ্বস্ত করেন। পরে আমরা চলে আসার সময় পেছন থেকে হঠাৎ হামলা চালানো হয়।
চিকিৎসা খরচ কিভাবে দিচ্ছেন?
দ্বিজেন টুডু: বাড়ি থেকে যে টাকা নিয়ে এসেছিলাম, তার পুরোটাই চিকিৎসার পেছনে খরচ হয়ে গেছে। এখন হাত পুরো ফাঁকা। হাসপাতালে দেখতে এসে কয়েকজন আর্থিক সহায়তা দিয়ে গেছেন। ওই টাকা দিয়েই চিকিৎসা চলছে। খাবার কিনে খাওয়ার মতোও সামর্থ নেই। হাসপাতাল থেকে যে খাবার দিচ্ছে বোন মার্থা টুডুকে নিয়ে তাই ভাগাভাগি করে খাচ্ছি।