জন্মভূমির টান মানসিক কষ্টে ফেলে দেয়

প্রিয় বন্ধু,
কেমন আছ তুমি, কত দিন হলো তোমাকে লিখিনা। আমি যখন তোমার উপর রাগ করি বা ঝগড়া করি তোমাকে লেখা ছেড়ে দেই! কি করব বল আমি তো আমার প্রিয় বন্ধুকে লিখি বন্ধুর সঙ্গে রাগ করে কথা বলা বন্ধ করলে লেখা কোথা থেকে আসে বল। তুমি আমার উপরটা দেখ অন্তর দেখ না, অন্তর দেখতে পেলে কখনো আমার উপর রাগ করতে না। আমার দুনিয়া তোমাকে ঘিরে শুরু হয় তোমাতেই শেষ হয় এই কথা কবে বুঝবে বন্ধু বল? আমি মরলে!! গত কয়েকদিন যাবত খুব মনে পড়ছে তোমায় কারণ তোমাকে না জানিয়ে কোথাও যাই না কিন্তু আজ সানফ্রানসিসকো আসলাম, তুমি কথা বল না কিভাবে জানাবো বল?
ওকল্যান্ড কেলিফোর্নিয়ার একটি হোটেল রুমের ২০ তলার জানালা দিয়ে সানফ্রানসিসকো ব্রিজ ও সমুদ্র পারের মনোরম শহরের দিকে তাকিয়ে আছি আর ভাবছি তোমাকে চিঠি লিখা শুরু করতে হবে। যখন লেখা নিয়ে ভাবি মাথায় কিছু আসে না কি নিয়ে লিখব কোথা থেকে শুরু করব কোথায় শেষ করব। মজার বিষয় লিখতে শুরু করলে একটার পর একটা ভাবনা এমনিতে এসে হাজির হয়। যা বলছিলাম আমি এখন ওকল্যান্ডে আছি, সমগ্র আমেরিকার তৃনমূল এশিয়ান সংগঠন গুলির জাতীয় সম্মেলনে যোগ দিতে ৪ দিনের সফরে এখানে এসেছি।
সম্মেলনের প্রথম দিনের কর্মসূচি দেরীতে শুরু হবে তাই আমরা শহরটা ঘুরে দেখার একটু সুযোগ পেলাম। আমাদের সংগঠনের সকলে মিলে চলে গেলাম বে ব্রিজ ও গোল্ডেন ব্রিজ দেখতে। ছোট বেলায় কোথায় যেন পড়েছিলাম সাগরের উপরে ব্রিজ গুলির কথা তাই অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল এখানে আসার। হোটেল থেকে বের হতেই দেখি ঝির ঝির বৃষ্টি প্রথমে দমে গেলেও উপলব্ধি করলাম এই বৃষ্টি নিউ ইয়র্কের মতো ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া বৃষ্টি নয়। আমাদের মধ্যে যাদের নিজ দেশের স্মৃতি আছে তারা বুঝতে পারলাম এ যেন নিজের দেশের সেই ভালোলাগার বৃষ্টি।
নেপালের মেয়ে আনশু বলল আপা তুমি কি বাংলাদেশে থাকতে বৃষ্টিতে ভিজেছ? আমি বললাম কতবার, চোখের সামনে ভেসে উঠছিল ছোট বেলার বৃষ্টিতে ভিজে গোসল করা। মনে পরে ঝুম বৃষ্টিতে প্রিয় বান্ধবী নুপুরকে নিয়ে রিকশার হুড ফেলে চলা আর রিকশা ওয়ালা ভাই এর অতি বিরক্ত চাহনি উপেক্ষা করে বৃষ্টি বিলাস উপভোগ করা। এই পড়ন্ত বেলায় আজও যখন সেই সব দিন রাত্রির কথা মনে পরে মনটা হাহাকার করে উঠে।বন্ধু আমি কি কখনো তোমার সঙ্গে বৃষ্টিতে রিকশার হুড ফেলে ভিজেছিলাম? আমার মনে পরে না স্মৃতি বড় ঝাপসা হয়ে আসছে আজকাল।
প্রবাস জীবন আমাদের ডলার দিয়েছে কেড়ে নিয়েছে বাকি সব মধুর স্মৃতি। সানফ্রানসিসকো শহরের বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে পথ চলছিলাম আর ভাবছিলাম আহা আমি কিছুক্ষণের জন্য ভাবি আমি বাংলাদেশেই আছি। ট্রেন থেকে নেমে প্রথমে গেলাম বে ব্রিজ দেখতে তারপর গোল্ডেন ব্রিজ দেখার জন্য নেভি পিয়ের ধরে হাটছিলাম। সাগরের ঠাণ্ডা হাওয়া ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি মনে হচ্ছিল জীবন ওখানেই থেমে যাক। আজ তোমাকে খুব মিস করছি বন্ধু যখন কোনো নতুন জায়গায় বা সুন্দর জায়গা দেখি তা প্রকৃতি বা ঐতিহাসিক জায়গা যাই হউক তোমাকে পাশে পেতে ইচ্ছা হয়!! আজ গোল্ডেন ব্রিজ যেতে যেতে পিয়ের ৩৯ এ থামলাম শীল ফিস দেখতে একটা দুইটা নয় দেখা মিলল জাকে জাকে শীল ফিস, জেটিতে উঠে কেউ খেলা করছিল কেউবা অলস ঘুম। সবাই টুকিটাকি কেনাকাটা করলাম তোমার জন্য একটা শার্ট নিলাম যেদিন ঝগড়া মিটে যাবে সেদিন দিব। শপিং শেষ করে সঠিক টাইমে দৌড় দিলাম সম্মেলনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে হাজির হতে।
যথা সময়ে শুরু হলো অনুষ্ঠান তেমন গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা বা বিবৃতি নয় শুধু বলা হলো আমরা কি উদ্দেশে ১৬০ জন সংগঠক দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জমা হয়েছি। এর পর ডিনার এ সময় জানানো হলো পরের দুই দিন অনেক প্যানেল আর ওয়ার্কশপ আর ছোট ছোট গ্রুপে আলোচনা হবে। আমি খাওয়ার পরে রুমে ফেরত গেলাম অনেক সকালে উঠতে হবে যা আমার মতো দেরীতে ঘুম থেকে মানুষের জন্য কঠিন কাজ।
সকালে উঠে সাড়ে আটটার টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম সেমিনার কক্ষে নাস্তা হাতে বসে গেলাম উদ্বোধনী আলোচনা শুনতে। চারজন বক্তার মাঝে ১ জন ড্রামের নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহাদ আহমেদ, চমৎকার সঞ্চালনিতে উঠে আসে ৪টি সংগঠনের গুরুত্তপূর্ণ কাজ সমুহ। আমি এশিয়ান সম্মেলন গুলিতে আসলে মনে করি এত আপন নাড়ির টান অনুভব করি যা অন্য জায়গায় অতটা নয়। আমি ড্রামের কাজে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সম্মেলন সেমিনারে যাওয়ার কারণে ইস্ট এশিয়ান সংগঠনের সঙ্গে সংগঠকদের সাথে পরিচয় বা তাদের কাজ জানার সুযোগ হয়। কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, লাউস পেসেফিক আইল্যান্ড থেকে হাজার হাজার মানুষ ভিয়েতনাম যুদ্ধের ফলে রিফিউজি হিসেবে এই দেশে আসে।
ভাষা না জানা বৈরি আবহাওয়া বিপর্যস্ত মানুষ আর তাদের জীবনের কথা তাদের সংগঠক সন্তানদের মুখ থেকে শুনতে পাই যা আগে এতোটা জানতাম না। তোমার মনে আছে বন্ধু তোমাকে অন্য একটি চিঠিতে লিখেছিলাম সিয়াটলের একটি জেল পরিদর্শন ও কয়েদীদের দুঃখের কথা তখন এই গ্রুপের সাথেই গিয়েছিলাম। বলা হয়ে থাকে আমেরিকার ইতিহাসে সবচে বড় অংকের রিফউজি তৈরি হয় ভিয়েতনাম যুদ্ধের কারণে, সেই সময় ইস্ট এশিয়া থেকে আনা হয় বড় অংকের রিফিউজি আর আমেরিকার কারণেই এত বেশি মানুষ সেই সময়ে রিফিউজি হয়।
অনেক বছর হয়ে গেল এখনো সেই সমাজের সামাজিক বৈষম্য মানসিক কষ্ট নিজের দেশের মাটির জন্য হাহাকার কমেনি। পুঁজিবাদ যুদ্ধের মাধ্যমে মানবিক বিপর্যয় তৈরি করে আর ক্ষতিগ্রস্ত দেশ থেকে কিছু মানুষ আশ্রয় দিয়ে ভাবে দায় ভার শেষ। আমেরিকার মতো পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলি যুদ্ধের মাধ্যমে অস্ত্রের মুনা্ফা কামানো আর আক্রান্ত দেশের প্রাকৃতিক বা খনিজ সম্পদ লুট করা ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না আমার জানা নেই। বন্ধু আমরা যখন এদের দুঃখের কথা শুনি চোখের সামনে বর্তমান আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, ইয়ামেনের মানুষের মুখ ভেসে ওঠে। আজ হয়ত এরা আশ্রয় সন্ধানে দেশে দেশে সীমান্ত পারি দিচ্ছে কিন্তু এক সময় ফেলে আসা জন্মভূমির টান মানসিক কষ্টে ফেলে দিবে।
৩ দিনের সম্মেলন শেষ হলো। তৃতীয় দিন দুপুরের পরে আমাদের নিউ ইয়র্কে ফেরার প্লেন রাতে তাই আমরা চলে গেলাম মিশন ডিসট্রিক্ট এ মিউরাল দেখতে ও আমাদের এক সাথী সংগঠন পরিদর্শন করতে। মিশন ডিসট্রিক্ট এর পথে পথে হেটে যখন মিউরাল দেখছিলাম মনে হল বাংলাদেশের রাস্তায় হাঁটছি। ঠিক বাংলাদেশের মতো রাস্তার ওয়াল মানুষের বাড়ির বাইরের দেয়ালে দোকানের সাটারে মিউরাল আঁকা। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় ১৭৯১ সালের দিকে নেটিভ আমারিকান আর স্প্যানিশ মানুষেরা এই ঐতিহ্যবাহী মিশন ডিসট্রিক্ট গড়ে তুলে। আজও মিশন ডিসট্রিক্ট এর কিছু কিছু রাস্তা বা দোকান পুরানো দিনের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে।রাতের খাওয়া মিশন ডিসট্রিক্ট এর পুরানো এক স্প্যানিশ রেস্টুরেন্ট খেয়ে দৌড় দিলাম এয়ারপোর্ট এর উদ্দেশে। নিউ ইয়র্কে ফিরতে হবে তাই ফেরা মন পরে রইল মিশনের মিউরালে যেখানে বাংলাদেশ এর ঘ্রাণ পেয়েছিলাম। বন্ধু সেদিন ঘুরনাক্ষরেও জানতাম না বাংলাদেশের মাটির ঘ্রান আমাকে এত জলদি কাছে টেনে নিবে।
নিউ ইয়র্কে ফিরে কঠিন ব্যস্ততায় পরে গেলাম, আমাদের এক সম্মানিত লিডারের বাড়িতে ইমিগ্রেশন পুলিশ এসেছিল যখন আমরা সানফ্রানসিসকোতে। আমাদের বা ওনাদের ভাগ্য ভাল ওনার ছেলে মেয়েরা বুদ্ধিমত্তার সাথে ইমিগ্রেশন পুলিশকে মোকাবেলা করেছে দরজা খুলেনি। ৩ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করে তারা চলে যায়, কিন্তু নিরাপত্তা হুমকি ত রয়েই যায়। আমি নিউ ইয়র্কে ফিরেই ওনাদের পরিবারের নিরাপত্তা প্রধানের যাবতীয় ব্যবস্থার জন্য কাজ শুরু করি। আমাদের কাছে খবর এসেছে জামাইকা এলাকায় আরও অনেক বাড়িতে ইমিগ্রেশন পুলিশ হানা দিচ্ছে যা অন্য এলাকায় এতোটা শোনা যাচ্ছে না। আমাদের আরো অনেক সতর্ক থাকতে হবে, মনে রাখতে হবে কোনো অবস্থায় দরজা খোলা যাবে না। যদি তারা কোনো কাগজ বা ছবি দেখাতে চায় তবে দরজার নীচ দিয়ে দিতে হবে।
যদি তাদের কাছে ওয়ারেন্ট থাকে ঘরের কোনো ব্যক্তির নামে তবে ওই ব্যক্তি দরজা খুলে বাইরে যেতে হবে আর দরজা পিছন থেকে বন্ধ করে দিতে হবে। ওই ব্যক্তির যদি উকিল থাকে তবে উকিলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে নইলে তার জন্য উকিল ধরতে হবে। উকিলের উপস্থিতি ছাড়া তাদের দেয়া কোনো কাগজে সই করা যাবে না এই ভাবে মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করতে হবে। নিজে নিরাপদ থাকা আর বাড়ির সকল কাগজ পত্রবিহীন মানুষকে নিরাপদ রাখার জন্য ইমিগ্রেশন পুলিশের সামনে আপনার অধিকার কি কি তা জানা খুব জরুরি। আমি ধান বান্তে শিবের গীত সবসময় গেঁয়ে ফেলি কি করব এখন এই সময়ে এই সব কথাই বোধহয় সবচেয়ে গুরুত্তপূর্ণ কারণ এই লিখা শেষ করার পূর্বেই আমাদের আর এক সদস্যর বাড়িতে ইমিগ্রেশন পুলিশ সেটাও জ্যামাইকা এলাকায়। বন্ধু জামাইকা কেন ইমিগ্রেশন পুলিশের টার্গেট হলো বোঝা মুশকিল আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করছি সমাজের মানুষ রক্ষা করতে তারপরেও অনেকে ইমিগ্রেশন পুলিশ আসলে দরজা খুলে দিয়ে বিপদ ডেকে আনে।
বন্ধু আমার ছোট ভাইটির ব্রেন স্ট্রোক হবার কারণে এই চিঠি লিখা শুরুর পরে আমি বাংলাদেশে গিয়েছি তোমার সাথে দেখা হয়েছে, তোমার অনেক সহযোগিতা পেয়েছি। আমি ৯ বছর পরে গিয়ে ৬ দিন থেকে চলে আসলাম!! পরের চিঠিতে লিখব কি হয়েছিল আর কেমন কেটেছে ৬ দিন ততক্ষণ ভাল থাক বন্ধু ভাল থাকুক দেশ ও দেশের মানুষেরা।
ইতি
তোমার বন্ধু যাকে কোন নামেই ডাকো না।
কাজী ফৌজিয়া, মানবাধিকার কর্মী