
তসলিমার জন্যে পঙ্ক্তিমালা
।
তসলিমা, প্যারিসের কিয়দ্দুরে একটি মনোরম
সবুজ-ওড়না জড়ানো শান্ত এলাকায়
এক রাত্তিরে তুমি ছুটে এলে এই অসুস্থ, ভাঙাচোরা
আমার কাছে। আমি জানি, তুমিও ভালো ক’রেই জানো,
তসলিমা, যে যাই ভাবুক, তোমার আমার সম্পর্ক
চাওয়া-পাওয়ার কোন বুনিয়াদে স্থাপিত নয়।
তসলিমা, তুমি যে বিষাক্ত শরাহত কাতর
হরিনীর মতো তা’ বুঝতে আমার কষ্ট হয়নি। হ্যাঁ, তুমি
নাছোড় আকুলতায় হাজির হয়েছিলে, ঘন ঘন সিগারেট ফোঁকা
তোমার মনের আবহাওয়াকে নগ্ন করে
তুলেছিল; বেদনা দরবারী রাগ হয়ে
ছড়িয়ে পড়ছিল তোমার সত্তাকে ঘিরে। তোমার দু’টি চোখ
বিস্তারিত বর্ণনাকে টপকে এক সীমাহীন যন্ত্রনার
ইতিহাসকে প্রকাশ করছিল আশ্চর্য ভঙ্গিতে।
খ্যাতির জৌলুশ এখানে বল ডান্সে মগ্ন তোমার সঙ্গে,
চারপাশ থেকে তোমার দিকে এগিয়ে আসছে শ্যাম্পেনের
বোতল, পানপাত্র, ভোগবাদী দর্শনের টানাহ্যাঁচড়ায়
তসলিমা, তুমি ক্লান্ত, ক্লান্ত বড় ক্লান্ত হ’য়ে পড়েছ,
দেখতে পেয়ে তোমার মনে বিষন্নতার লতাগুল্ম ঝুলে রইল।
ভীষন ব্যস্ত তুমি, যেন কোনও অতিশয় মূল্যবান রঙিন মাছ
আটকা পড়েছ জটিল জালে। তোমার ছটফটানি
আমি প্রত্যক্ষ করি তরুন বন্ধুর পাশাপাশি ব’সে তার ড্রইংরুমে।
না তসলিমা, তোমার আর কোনওদিনই খাওয়া হবে না
মায়ের হাতে রাঁধা ভাপ-ওঠা লাল চালের ভাত,
টাটকি মাছের ভর্তা, শিং মাছের ঝোল; তোমার মা আর
কোনওদিন উত্তর আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে
তোমার অপেক্ষার নির্ঘুম রাত কাটাবেন না, তোমার
কল্যানের জন্যে খোদার আরশে মাথা লুটিয়ে
পড়ে থাকবেন না। না তসলিমা, মার সঙ্গে
তোমার কস্মিনকালেও আর দেখা হবে না। এ কথা অনেক আগেই
জেনে গেছ তুমি। তোমার সুতীক্ষ্ণ বোধ আমাকে
অনেক কিছুই খোলা রাস্তায় ন্যাংটো করতে শিখিয়েছে।
.
তসলিমা, তোমার কি মনে পড়ে সেই সব আগুনে ঝলসানো
দিনগুলোর কথা, যখন তুমি, নির্মলেন্দু গুন, মহাদেব সাহা, আমি
কতিপয় তরুন তরুনী ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিয়েছি
তোমার ফ্ল্যাটে আমাদের প্রিয় ঢাকা শহরে
তোমার সম্ভাব্য বিপদের আঁচ ক’রে। প্রতিটি
মুহুর্ত আমাদের কেটেছিল, আশঙ্কায়, আতঙ্কে এবং
শাসন-না-মানা এক ধরনের আনন্দে। সেই অতিবাহিত সময়
আজও মনে যুগপৎ বেদনা ও আনন্দের প্রহর ডেকে আনে
রাখালিয়া সুরের মত। তসলিমা, তুমি সেই সুরে
ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হও মৈয়মনসিং-এর কোনও পুকুরঘাটে,
ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, আড়িয়াল খাঁর তীরে, ফেব্রুয়ারির বইমেলায়
কলকাতার কফিহাউসে কলেজ স্ট্রিটে।
তসলিমা, তুমি সেই রাতে শুধু আমাকে দেখার জন্যেই
ছুটে আসো নি প্যারিসের কিয়দ্দুরে এক শান্ত এলাকায়। লুকিও না,
সত্যি কথাটা বলেই ফেলো, তুমি তো স্পষ্টভাষিণী। আসলে
তুমি আমার কাছে এসেছিলে ঢাকা শহরের বুড়িগঙ্গা নদী, রাস্তার
ধুলোর ঘ্রান শুঁকে নিতে, কান পেতে শুনতে
বাংলাদেশের হৃৎস্পন্দন, তুমি বিদেশে স্বদেশকে আলিঙ্গন
করতেই এসেছিলে ছুটে গোল্লাছুট খেলতে আসা বালিকার ধরনে।
অথচ এই দেশ থেকেই তোমাকে কতিপয় অন্ধ, নির্বিবেক, নিষ্ঠুর লোক
হিঁচড়ে টেনে বের ক’রে দিলো দু’দেশের সীমানা-চিহ্নিত
কাঁটাতারের ওপারে, যেখানেও আখেরে ঠাঁই হল না তোমার।
।
শামসুর রাহমান
১৩-০৫-২০০০ইং