
কাজি ফৌজিয়া:
নিশি অবসানপ্রায়, ওই পুরাতন বর্ষ হয় গত আমি আজি ধূলিতলে এ জীর্ণ জীবন করিলাম নত। বন্ধু হো, শত্রু হও, যেখানে যে কেহ রও, ক্ষমা করো আজিকার মতো পুরাতন বরষের সাথে পুরাতন অপরাধ যত। — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রিয় বন্ধু,
কেমন আছ তুমি, শুভ নববর্ষ। নতুন বছরের শুরুতেই তোমাকে লিখছি। গতকাল ইস্তাম্বুল থেকে ইতালি এসেছি। চারদিন ছিলাম ইস্তাম্বুল শহরে। আমরা ইস্তাম্বুল ছাড়ার ৬ ঘণ্টার মধ্যে ঘটে গেল বড় ঘটনা। ইস্তাম্বুল ক্লাবে হামলা প্রায় ৪২ জন মানুষ নিহত হয়। আমরা যখন থেকে টিকেট কেটেছি তখন থেকেই ঘটে গেল অনেক ঘটনা। স্টেডিয়াম ও পুলিশের উপর হামলা, রাশিয়ান অ্যাম্বাসেডর খুন, পূর্বের আরও হামলা মিলিয়ে অনেকেই আমাদের নিষেধ করেছিল ইস্তাম্বুল না যেতে। রিমার স্বামী শাহিন তো পারলে প্রতিদিন টিকেট চেঞ্জ করে, আমি আর রিমা চিন্তা করলাম টার্কি এয়ার লাইন্স এ যাচ্ছি, মক্কা-মদিনা থেকে ফেরার পথে ৪ দিন ইস্তাম্বুলে বিরতি নিলে একটা নতুন জায়গা, নতুন সভ্যতা দেখা হবে। যেই চিন্তা সেই কাজ। অনিরাপদ জেনেও ইস্তাম্বুল এ চারদিন রয়ে গেলাম। আল্লাহ পাকের অশেষ রহমতে আমরা উড়াল দেওয়ার পরে ঘটেছে এই ঘটনা, নইলে এয়ারপোর্টে নিরাপত্তা কর্মীদের বাড়তি নজরদারিতে পরতাম আমরা।
আমি ইস্তাম্বুল যাওয়ার স্বপ্ন দেখতাম অনেক দিন থেকে, অটোম্যান সালতানাত এর সময়ের অনেক স্থাপত্যকলা, মিউজিয়াম, ঐতিহাসিক ব্লু মসজিদ ও সুলেমানী মসজিদ দেখার জন্য। জেদ্দা থেকে ইস্তাম্বুল সাবিহা এয়ারপোর্ট পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমাদের সকাল হয়ে গেল, এয়ারপোর্ট থেকে পুরাতন ইস্তাম্বুল যেতে যেতে দূরে পাহারের ভাঁজে ভাঁজে ছবির মত সাজানো পুরাতন শহর আর ব্রিজের এই পারে নতুন স্থাপত্যর নিদর্শন নজরে পড়ল। চলতি গাড়ি থেকে দেখা ইস্তাম্বুল আমার মন কেড়ে নিল, মনে মনে বলাম, ‘ধন্যবাদ রিমা এমন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আর তাতে অটল থাকার জন্য’।
হোটেলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ১১টা বেজে গেল। কিছুটা ফ্রেশ হয়ে গেলাম লাঞ্চ করতে। হোটেল থেকে বের হয়ে বা দিকে একটু পাহারের দিকে গেলে সারি সারি খাবারের দোকান। ইলেক্ট্রিসিটি ছিল না, হ্যাজাক লাইট দিয়ে বিক্রেতা কি কি খাবার আছে দেখালো। আমরা খাবার পছন্দ করে বসে গেলাম খেতে। ধীরে ধীরে আমরা জানতে পারলাম এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন এলাকা। সারা বছর এখানে পর্যটক আসে তাই এত খাবার আর হস্তশিল্প আর উপহার সামগ্রীর দোকান। আজও এখানে বিক্রেতারা পসরা সাজিয়ে বসে আছে কিন্তু তেমন ক্রেতা নেই।
বন্ধু, আমরা ইস্তাম্বুলের বিখ্যাত মিউজিয়াম টপকাপির একদম কাছে ছিলাম। বিকালে বের হলাম ব্লু মসজিদ দেখতে। মাগরিবের নামাজ ব্লু মসজিদেই আদায় করলাম। অটোম্যান সালতানাতের বিখ্যাত নিদর্শন এই মসজিদ। আজও এখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ হয় আবার পর্যটকও ভিড় জমায়। ব্লু মসজিদের সামনে হাজিয়া সোফিয়া যাদুঘর। সারা বছর এখানে পর্যটক গিজ গিজ করলেও এখন ফাকা। দু-চার জন আমাদের মত ঘুরাঘুরি করছে। ইদানীং ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার কারণে পর্যটক হয়ত আসতে ভয় পাচ্ছে। আমার একটা কথা বার বার মনে হচ্ছিল, পৃথিবীর প্রতিটা দেশ ধ্বংস করার পূর্বে তার পর্যটন শিল্প কে আগে ধ্বংস করা হয়। তাই ইস্তাম্বুল দেখে মনে হচ্ছিল, হয়তো শেষ হয়ে যাওয়ার পূর্বের ইস্তাম্বুল দেখছি আমরা।
যা কিছু সামনে আসছিল তার সবই ভীষণ সুন্দর ও ঐতিহাসিক নিদর্শন। এর সবকিছুই কেবল মুসলিম স্থাপত্যকলা নয়, তার সাথে মিশে আছে রোমান আর গ্রিক স্থাপত্য কলাও। মনের মধ্যে একটাই প্রশ্ন বার বার জেগে উঠছিল, এর কিছুই কি টিকে থাকবে না! এগুলোও কি ধ্বংস হবে ইরাক আর সিরিয়ার মতো? ঐ দুইটি দেশও ছিল ঐতিহাসিক স্থাপত্যে সমৃদ্ধশালী। আজ সিরিয়া আর ইরাক দেখলে মনে হয়, কিছুই নাই- কিছুই ছিল না হয়ত কোনদিন। আমি যে দেশে থাকি বা তার মত বড় দেশগুলোর কু-নজরে আজ তুরস্ক পরে গেছে। সুতরাং এই দেশ এই অবস্থা থেকে বের হবার পথ যদি না বের করতে পারে তাহলে আতঙ্কবাদ নির্মূলের নামে এই দেশে ড্রোণ, এয়ারস্ট্রাইক আর বম্বিং করা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
আমাদের আসার পরের দিন শুরু হল ঝড়োবৃষ্টি আর বরফ জমা ঠাণ্ডা। ঠাণ্ডার দেশে থাকি আমরা তারপরও এই পাহাড়ি ঠাণ্ডায় আমরা বিপর্যস্ত। সবাই মিলে পাহারের ডাল বেয়ে উপরে উঠে গেলাম টপকাপি মিউজিয়াম দেখতে। আমার তেমন কোন ধারণা ছিল না ভিতরে কি আছে। আমি ধারণা করেছিলাম হয়ত অটোম্যান সালতানাত এর সময়ের রাজকীয় জিনিসপত্র আছে। আমি অর্ধেক সত্য জানতাম। বাকিটা রিমা বলল যে, এখানে আমাদের নবীজি (সাঃ) ব্যবহৃত অনেক জিনিসপত্র আছে। টপকাপি প্রাসাদ ১৪৫৩ থেকে ১৮৫৩ পর্যন্ত অটোম্যান সালতানাত এর রাজপ্রাসাদ ছিল। পরে এই প্রাসাদটি বড় অফিসারদের থাকার জন্য নির্ধারিত হয়। তুর্কি সরকার ১৯২৪ সালে এই প্রাসাদকে মিউজিয়াম বানায়। এ মিউজিয়াম মুসলিম বিশ্বের মানুষের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কারণ এখানে আছে নবী (সাঃ) পাগড়ী মোবারক, বুকের কাপড়, উনার চুল, তলোয়ার, চিঠির বাক্স, হজরত আলী (রাঃ) তরবারি, মা ফাতেমার কামিজ, হুসেন (রাঃ) এর জামাসহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস।
অটোম্যান রাজাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র থরে থরে সাজানো আছে বিভিন্ন কামড়ায়। আমার কাছে খুব ভাল লেগেছে মিউজিয়ামটিকে ঘিরে এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। পাহাড়ি প্রকৃতির এক অপরূপ সৌন্দর্যের কারণে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজে জায়গা করে নিয়েছে এই স্থান। সব দেখে আমরা কাকভেজা হয়ে রুমে ফিরলাম। কিছুতেই শাহিন আর বাইরে যাবে না, তাই আমি, রিমা ও শাপলা বের হলাম কিছু কেনাকাটা করতে। ছোট ছোট গিফট শপ গুলোতে যা নজরে পরে সবই সুন্দর মনে হয়, সবই কিনি। খুঁজে বেছে অনেক উপহার কিনলাম আমেরিকাতে বন্ধু কলিগদের জন্য, সেই সাথে তোমার জন্যও। যাই দেখি মনে হয় তোমার জন্য নেই। এই দোকান গুলোতেও ভিড় কম কারণ পর্যটক নেই। কেনা-বেচাও তেমন নেই। আমি জানতে চাইলাম এরদোগান কেমন শাসক? সবাই বলল, সে ভাল কিন্ত আতঙ্কবাদ ভাল না। কোনো একটা গুষ্ঠি জেনে বুঝে আমাদের শেষ করতে চাইছে। আমাদের শাসককে এর সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।
তৃতীয় দিন গেলাম হাজিয়া সোফিয়া। একে কেউ কেউ বলে ‘আয়া সোফিয়া’। প্রথমে এটি ছিল গির্জা পরে হয়েছে মসজিদ, আর এখন এটি প্রত্নতাত্তিক জাদুঘর। বাইজেন্টাইন সম্রাটের আমলে ৫৩২ থেকে ৫৩৭ সালে এই ক্যাথেড্রাল গির্জাটি বানানো হয়। বলা হয়ে থাকে এটি ৩য় পবিত্র গির্জা। পূর্বের দুইটি রায়টের কারণে বিলুপ্ত হয়েছে। খ্রিস্ট্রাব্দ ৫৩৭ থেকে ১০৫৪ পর্যন্ত এটা ছিল ক্যাথেড্রাল গির্জা। ১০৫৪ থেকে ১২০৪ পর্যন্ত গ্রীক অর্থোডক্স গির্জা। ১২০৪ থেকে ১২৬১ পর্যন্ত রোমান ক্যাথলিক গির্জা। ১২৬১ থেকে ১৪৫৩ আবার গ্রীক অর্থোডক্স গির্জা। ১৪৫৩ থেকে ১৯৩১ ইম্পেরিয়াল মসজিদ। ১৯৩৫ থেকে এটি প্রত্নতাত্ত্বিক যাদুঘর হিসাবে আছে। এই স্থাপনাটি কালের সাক্ষী হয়ে পাহারের কোলে নদীর তীর ঘেঁসে দাড়িয়ে আছে।
মসজিদ হিসাবে বড় ইসলামী ক্যালিগ্রাফিতে নবীজির নাম, ৪ খলিফার নাম, ইমাম হুসেন ও ইমাম হাসান এর নামের প্লেট লাগানো আছে। ঠিক মিম্বরের উপরে ছাদে মাতা মেরি ও কোলে যিশু খ্রিষ্ট, দুই কোনায় এঞ্জেল ফ্লোরে রোমান রিচুয়াল এর ছক এখনও আছে। যে কক্ষে সুলতান মেহমুদ কোরআন পড়তেন তাও আছে। সব মিলিয়ে জাদুঘরটি স্থাপত্যকলার সাথে আন্তঃধর্মীয় স্থাপনার উৎকৃষ্ট উদাহরন।
এখান থেকে বের হয়ে আমরা গেলাম বাছিলিয়া (মাটির নিচের একটি শহর) দেখতে। হাজিয়া সোফিয়ার উল্টোপাশে এর অবস্থান। এই শহরের আয়তন ৫০০ মিটার, বানানো হয় ষষ্ট শতকে। হাজিয়া সোফিয়ার মতো এটিও বানিয়েছে বাইজেন্টাইন শাসক জাস্তিনিয়ান। বলা হয়ে থাকে তার ৭০০০ ক্রীতদাসকে সে এই কাজে লাগিয়েছিল। এটার ভিতরে কলামগুলোতে গ্রিক মিথ দেবী মেডোসার তিন বোন আছে। আমি মিথ অত ভাল বুঝি না, তাই নিশ্চিত করে বলতে পারলাম না, তবে এত বছর পূর্বের মাটির নিচের শহর এখনও টিকে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। একটি কথা না বললেই নয়, যত স্থানীয় মানুষের সাথে রাস্তায় হোটেলে দোকান পাটে দেখা হয়েছে সবাই ছিল ভীষণ বিনয়ী। শুনেছি ইউরোপের শহরগুলিতে যারা থাকে তারা ভীষণ উগ্র স্বভাবের হয়। আমার নিজের অভিজ্ঞতাও তত ভাল নয়। কিন্তু ইস্তাম্বুলে আমার একদল আন্তরিক মানুষের সাথে দেখা হল। আমার ভাবতে কষ্ট হচ্ছে এই পর্যটন এলাকায় ব্যবসা করা মানুষগুলিকে সবচে বেশী মুল্য দিতে হবে।
বৃষ্টির কারণে আমরা গ্র্যান্ড বাজার ডলবাচি প্রাসাদ আর মসলা বাজারে যেতেই পারিনি। পরের দিন সকালে উঠে নাস্তা খেয়ে চলে এলাম এয়ারপোর্ট। আসতে আসতে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস, হায় আবার যদি কখনো আসি এই শহরটি এমন থাকবে তো? আসতে আসতে আরও মনে হল সকলের বাধা ঠেলে আসলাম সহি সালামতে যাচ্ছি এইবা কম কি। রিমা চলে গেল শিকাগো, আমি ভেনিস। রাতেই তোমার কলে জানতে পারলাম ইস্তাম্বুল ক্লাবে হামলা। পরে কথা হবে ইতালি নিয়ে, ততক্ষন ভাল থাক বন্ধু। ভাল থাকুক আমার দেশ ও দেশের মানুষেরা।
ইতি
তোমার বন্ধু যাকে তুমি কোন নামেই ডাকোনা
লেখক: মানবাধিকার কর্মী