
শাকিরা তাসনিম ইরা, ঢাকা: ‘ফুলন দেবী’। নামটার সাথে আমরা মোটামুটি সবাই কম বেশি পরিচিত। মারকুটে, দস্যি কোনো মেয়ে দেখলেই আমরা তাকে ফুলন দেবী আখ্যা দিয়ে বসি। কিন্তু আমরা কতটুকু জানি ফুলন দেবীর সম্পর্কে?
ফুলন দেবী দস্যু রাণী হিসেবেই বেশি পরিচিত। কিন্তু তিনি ছিলেন একই সাথে নির্যাতিত নারীদের প্রতিনিধি। পরবর্তীতে রাজনীতিতেও যোগদান করেন তিনি।ভারতের নিচু বর্ণ হিসেবে পরিচিত মাল্লা বর্ণের এক পরিবারে ১৯৬৩ সালের ১০ আগস্ট জন্ম নেন ফুলন। দরিদ্র পরিবারে জন্ম হওয়ায় দারিদ্রতাই ছিল সবকিছু জুড়ে। মাত্র ১১ বছর বয়সে বিয়ে হয় পুট্টিলাল নামক বাবার বয়সী এক লোকের সাথে।
ছোটবেলা থেকেই নির্যাতিত হয়ে এসেছেন ফুলন দেবী। তার আশপাশের গ্রামে ছিল ঠাকুর বংশের জমিদারদের বসবাস। জমিদারের লোকেরা প্রায়ই গ্রামে এসে ফসল কেটে নিয়ে যেত এবং গ্রামের মানুষদের উপর নির্যাতন চালাত। ফুলন প্রতিবাদ জানিয়ে দখলদারদের নেতা মায়াদীনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করলে ঠাকুররা প্রতিশোধ নিতে তাকে তুলে নিয়ে যায়। চালায় অমানুষিক নির্যাতন। ২৩ দিন যাবত ঠাকুর ও তার লোকেরা ধর্ষণ করে ফুলনকে। একদিন মৃত ভেবে ফেলে রেখে গেলে সেই সুযোগে পালিয়ে যান ফুলন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর।
১৯৭৯ সালে মায়াদীন চুরির অভিযোগে ফুলনকে গ্রেফতার করালে তিন দিনের কারাবাস হয় তার। সেখানেও আইনরক্ষকের হাতে ধর্ষিত হন তিনি। কারাবাস থেকে ফেরার পর পরিবার ও গ্রাম থেকে বিতাড়িত হন তিনি। ফুলন দেবী আরেকবার ধরা পড়েন এক দস্যু দলের হাতে। দস্যুদের নেতা বাবুর নজর পড়ে ফুলনের ওপর। কিন্তু আরেক দস্যু বিক্রম এতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বাবুকে খুন করে ফুলনকে রক্ষা করে সে। এরপর ফুলনের সঙ্গে বিক্রমের বিয়ে হয় এবং শুরু হয় ফুলনের নতুন জীবন। রাইফেল চালানো শিখে ধীরে ধীরে পুরোদস্তর ডাকাত বনে যান তিনি।
ডাকাত দলে যোগদান করার পর তিনি প্রথমেই তার প্রাক্তন স্বামী পুট্টিলাল এর গ্রামে আক্রমণ চালান। ফুলন পুট্টিলালকে টেনে নিয়ে এসে জনসমক্ষে শাস্তি দেয় ও খচ্চরের পিঠে উল্টা করে বসিয়ে নির্জন স্থানে নিয়ে এসে বন্দুক দিয়ে প্রহার করে। প্রায় মৃত অবস্থায় পুট্টিলালকে ফেলে যায় সে। এর মধ্যেই একদিন ধনী ঠাকুর বংশের ছেলের বিয়েতে সদলবলে ডাকাতি করতে যান ফুলন। সেখানে ফুলন খুঁজে পান এমন দুজন মানুষকে, যারা তাকে ধর্ষণ করেছিল। ক্রোধে উন্মত্ত ফুলন দেবী আদেশ করেন বাকি ধর্ষণকারীদেরও ধরে আনার। কিন্তু বাকিদের পাওয়া না যাওয়ায় লাইন ধরে ঠাকুর বংশের ২২ জনকে এক সঙ্গে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলা হয়। বেমাইয়ের এই গণহত্যা ভারতবর্ষে ব্যাপক সাড়া ফেলে।
ফুলনকে ধরার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে সরকার। আবার ফুলনের পক্ষেও ভারত জুড়ে চলে আন্দোলন। একপর্যায়ে ১৯৮৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন সরকার সন্ধিপ্রস্তাব করেন এবং ফুলন সন্ধির জন্য বেশ কিছু শর্ত দেন। সরকার শর্ত মেনে নিলে ১০,০০০ মানুষ এবং ৩০০ পুলিশের সামনে মহাত্মা গান্ধী আর দুর্গার ছবির সামনে অস্ত্র সমর্পণ করেন ফুলন। ১১ বছর কারাভোগের পর ফুলন সমাজবাদী পার্টিতে যোগ দেন এবং ১৯৯৬ এবং ’৯৯-তে পরপর দুইবার লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হন।
২০০১ সালের ২৫ জুলাই সংসদ থেকে বের হয়ে আসার সময় নয়া দিল্লীতে ফুলন দেবীকে হত্যা করা হয়। ঠাকুর পরিবারের তিন ছেলে শের সিং রাণা, ধীরাজ রাণা এবং রাজবীর ফুলন দেবীকে এলোপাতাড়ি গুলি করে পালিয়ে যায়। হত্যাকারীরা পরবর্তীতে প্রকাশ করেন যে বেহমাই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এই হত্যা করা হয়েছিল।
দস্যু হবার সাথে সাথে নির্যাতিত নারীদের প্রতীকও ছিলেন ফুলন দেবী। তার অপরাধ জীবনের বেশিরভাগ অপরাধই তিনি সংঘটিত করেছেন নির্যাতিত নারীদের হয়ে প্রতিশোধ নেবার জন্য। দস্যু হওয়া সত্ত্বেও অনেকেই তাকে মায়াদেবী বয়লে আখ্যা দিয়েছেন। তার মুখের আদলেই একটা সময় গড়া হত দেবী দুর্গার প্রতীমা। দস্যুতার পাশাপাশি দয়া এবং মমতা দিয়েও অনেকের মন জয় করেছিলেন কিংবদন্তী এই ডাকাত সর্দার।
নিউজনেক্সটবিডি ডটকম/এসটিই/টিএস