
তুহিন দাস: কবি শ্রীজাত আবারও ভয়ের উৎসে নাটকীয় আঘাত হানলেন। বুধবার কবি শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৯৫-এ ধারায় ও সাইবার ক্রাইমের ৬৭ ধারায় মামলা রুজু করা হয়েছে শিলিগুড়ি আদালতে। এর মধ্যে ২৯৫-এ ধারাটি জামিন অযোগ্য।
যখন বাংলাদেশে মৌলবাদীদের চাপাতির আঘাতে ব্লগার-এক্টিভিস্ট-প্রকাশকদের হত্যাকাণ্ড নিয়ে ফেসবুকে ‘অন্ধকার লেখাগুচ্ছ’ লিখেছিলেন তখন অবাক হয়েছি। কেননা এ ঝুঁকি মিডিয়া প্রতিষ্ঠিত কবিরা নেয় না। কিন্তু শ্রীজাত তা নিয়েছিলেন। তিনি চুপ থাকতে পারেননি। সে কবিতাগুচ্ছ পরে বই আকারে প্রকাশিত হয়, এমনকি সে কবিতা নিয়ে ‘শঙ্খমালা’ নামের নাটকের দলটিও একটি প্রযোজনা করেছিল। হ্যাঁ, আমার ভয় এবার সত্যি হল। শ্রীজাতকে নিয়ে সেই নোংরা লোকেরা মেতে উঠেছে তাকে তুচ্ছ প্রমাণ করার জন্য। একমাত্র বাঙালিদেরই সাজে যে অমুক কবি নয়, অমুক লিখতে পারে না—এমন কথা বলার। পৃথিবীর আর কোন দেশের লোকেদের এমন কথা কাউকে বলতে দেখি না। জীবনানন্দ বলেছিলেন, ‘কবিতা নানারকম।’ আমরা জানি আজ তার শ্রেষ্ঠ সময়। কিন্তু আমরা কি জীবনানন্দকে তার সময়ের একমাত্র কবি বলে মানব? আমি বরিশালের মানুষ হয়েও তা মানব না।

নিজের লেখা কবিতা ‘অন্ধকার লেখাগুচ্ছ’ নিয়ে মঞ্চে শ্রীজাত
শ্রীজাত মাঝে মাঝে ভাল কবিতা লেখেন, কিন্তু তাকে ফরমায়েশি কবিতাও লিখতে হয়, যেসব কবিতা পাঠক পড়তে চায়। যেমন: পহেলা বৈশাখের কবিতা, মে দিবসের কবিতা, অন্য কবির জন্মদিনের কবিতা, অন্য কারো মৃত্যুদিনের কবিতা, এবং রাজনৈতিক সমর্থনের কবিতা। বিমূর্ত কবিতা লিখে অসৃষ্টিশীল মানুষের চিন্তায় অভিঘাত দেয়া সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষ একটি শব্দ, একটি বাক্য, একটি চিহ্ন, প্রতীক দিয়ে আলোড়িত হয় মাত্র। তাই একাডেমিশিয়ানদের জন্য ভালো কবিতার যেমন দরকার আছে, তেমনি সাধারণ মানুষদের জন্য ফাংশনাল কবিতারও দরকার আছে। যেমন: শ্লোগান। বাংলাদেশে আমরা ৯০ দশকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনের সময়ে বুকেপিঠে নূর হোসেনের (পুলিশের গুলিতে নিহত) লেখা শ্লোগানের শক্তি দেখেছি। এর মাঝে কবিতার রাজনৈতিক শক্তি নামে একটি গদ্য লিখেছি, কখনো হয়তো আপনাদের পড়তে দেব। সেখানে আমি দেখিয়েছি বাংলাদেশে আমার প্রজন্মে প্রগতিশীলতার বিস্তারের পেছনে মাত্র কয়েকটি অনুষঙ্গ নিয়ামক ছিল, যেমন কিছু গান-কবিতা-মঞ্চনাটক। আর একজন লেখক নানাভাবে লিখতে না পারেন তার যদি সে সামর্থ্য না থাকে সে আবার লেখক হল কিসে? আসলে কবিতা-অকবিতা বলে কিছু নেই, সমস্ত শব্দগুচ্ছ একজন মানুষের মনবিশ্বের প্রতিবিম্বপ্রদানকারী। ধর্মীয় উগ্রবাদী মন্তব্যকারী উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পর ফেসবুক পেজে একটি কবিতা পোস্ট করেন শ্রীজাত; সে কবিতা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে তা নিচে দিলাম—
‘সময়ে ওষুধ, নইলে বেড়ে যায় সবরকম রোগই
ভিখ পেতে পেতে তুমি রাজা হয়ে ওঠো, গেঁয়ো যোগী।উঠেই নির্দেশ দাও, ধর্মের তলব দিকে দিকে
মৃগয়ায় খুঁজে ফেরো অন্য কোনও ধর্মের নারীকে।যে–হরিণ মৃত, তারও মাংসে তুমি চাও অধিকার
এমন রাজত্বে মৃত্যু সহজে তো হবে না তোমার।বাতাসে হাপর নামে, দেশ জুড়ে অধর্মের ছাই…
প্রতি নির্বাচনে আমরা শতাব্দীপিছনে ফিরে যাই।যেখানে পুরুষধর্ম ধর্ম-পুরুষের অন্য নাম
আর আমি নারীর মৃত্যু পার করেও শিকার হলাম।আমাকে ধর্ষণ করবে যদ্দিন কবর থেকে তুলে—
কন্ডোম পরানো থাকবে, তোমার ওই ধর্মের ত্রিশূলে!’(অভিশাপ/শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়)
ব্যক্তিমানুষ মরে যায়, হারিয়ে যায় তার সমস্ত কাজকর্ম; শুধু থেকে যায় দুধের উপর সরের মতো তার লেখাটুকু। সে জায়গায় শ্রীজাতের এ ‘অন্ধকার লেখাগুচ্ছ’ থাকবে, থাকবে সমস্ত ধর্মচিহ্নে (ত্রিশূলে) তার পরানো কনডম, যার অর্থ আমার কাছে উগ্র ধর্মবাদের যে অহরহ সন্তানসম্ভবা দশা, একের পর এক উন্মাদ ধর্মশিশুর জন্ম নেয়া তার রোধ। সন্ত্রাসের বাতাবরণের মাঝে শ্রীজাত নিরব থাকেননি, জামিন অযোগ্য ধারার মামলা হয়েছে। বাংলাদেশে, ভারতে, পাকিস্তানে একের পর লেখক খুনের ঘটনা ঘটছে। জানি না হয়তো আমার শঙ্কা একদিন সত্যি হবে, ধর্মবাদের প্রপাগান্ডা মেশিন যেভাবে বাংলাদেশ, ভারতে, পাকিস্তানে শক্তিশালী হয়ে উঠছে এসব ধর্মউন্মাদ লোক যাদেরকে তিনি নির্বাচনের সময়ে সমর্থন দিয়ে লেখেননি ও ভাগাড় ঘাঁটা পাতি বুদ্ধিজীবীদের জন্য শ্রীজাতকেও একদিন দেশত্যাগের যন্ত্রণা গ্রহণ করতে হবে। উগ্র ধর্মবাদ নিপাত যাক, বাংলার মানুষ মুক্তি পাক। বাক স্বাধীনতা সরব থাক।

লেখক: কবি