
ঢাকা: গত ৩০ অক্টোবর হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলার পর থেকেই নাসিরনগরের পাড়ায়-মহল্লায় পাহারার ব্যবস্থা করেছিল এলাকাবাসী। তাদের সঙ্গে ছিলেন পুলিশের কিছু সদস্যও। আক্রান্ত হিন্দু পল্লীটি নিয়মিত দেখতে এসেছেন এলাকায় মন্ত্রী, এমপিসহ সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তারপরও আবার আক্রান্ত হলো নাসিরনগরের ওই হিন্দু পল্লীটি। বৃহস্পতিবার দিনগত ভোর ৩টার দিকে পাহারা শেষে স্থানীয় এলাকাবাসী যখন কেবল বাড়িতে ফিরেছেন, ঠিক তখনই আবার নাশকতা। সবাই যখন ঘুমে অচেতন, তখনই চারটি পাড়ায় আলাদা পাঁচটি বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। আগুনে পুড়ে যায় একটি বাড়ির দুর্গা প্রতিমাও।
এই ঘটনার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে চলছে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী নানা আলোচনা-সমালোচনা। স্থানীয় মৌলবাদীদের পাশাপাশি অনেকেই আঙ্গুল তুলছেন প্রশাসনের দিকেও। কেউ কেউ দায় নিতে বলছেন রাষ্ট্র ও সরকারকে।
গত ৩০ তারিখে নাসিরনগরে হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজ লিখেছিলেন,
জাত্যাভিমানের কারণে, ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বাংলাদেশের সংবিধান থেকে শুরু করে সাধারণ কথোপকথন পর্যন্ত সর্বত্র যে উগ্র জাতীয়তাবাদী ঔদ্ধত্য, যে মেজরিটারিয়ানিজমের (সংখ্যাগুরুবাদ) দাপট তার পরিণতি হল বাংলাদেশে বারবার সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, তাঁদের নিরাপত্তাহীনতা– ভাষাগত, ধর্মীয়, কিংবা রাজনৈতিক সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত। এই পরিস্থিতি বুঝতে গিয়ে অর্জুন আপ্পাদুরাইয়ের কথা মনে পড়ছে; ‘ফিয়ার অফ স্মল নাম্বারস’ যারা পড়েছেন তাঁদের কাছে এসব কথা সম্ভবত নতুন শোনাবে না। আত্মপরিচয় নিয়ে আমিন মালুফের বই ‘ইন দ্য নেইম অফ আইডেন্টিটি’-এর পাঠকেরা জানেন আমরা আইডেন্টিটির নামে কি ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করি। মনে করা দরকার ‘আমরা’ এবং ‘তাহারা’ – র আড়ালে আমরা কি ভাবে তৈরি করি শত্রু, ঘরের ভেতরে এবং বাইরে। বাংলাদেশের একজন নির্বোধ রাজনীতিবিদ মন্ত্রী যে বলেছিলেন ‘লুকিং ফর শত্রুজ’ তার চেয়ে বড় সত্য আর হয়না। আমরা ক্রমাগতভাবে শত্রুর খোঁজে নিয়োজিত। আজ না পেলে কাল অবশ্যই পাবো, কেননা তাদের শত্রু হতে হবে না আমরা তাঁদের শত্রু হিসাবে ‘নির্মান’ করব।
ফলে (রোববার ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে) যা ঘটছে তার দায়িত্ব নামহীন গোত্রহীন মানুষদের উপর চাপিয়ে দিয়ে যারা আত্মপ্রসাদ পেতে চাইছেন তাঁরা একবার আয়নার সামনে দাঁড়ালে সম্ভবত এ কথা বলতে দ্বিতীয় বার ভাববেন। যারা আগুন লাগিয়েছেন, ধ্বংসলীলায় অংশ নিয়েছেন তাঁদের অপরাধ আইনী কিন্ত আমরা যারা এই পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক ও বৈধ করে তুলেছি দিনের পর দিন, বছরের পর বছর তাঁরা কেন এই অপরাধের দায় মুক্ত হবো? … তাঁরা কি এর কোন দায় নেবো না?
নভেম্বরের ৪ তারিখে দ্বিতীয় হামলার পর তার ফেজবুক পাতায় আর কোন মন্তব্য লিখেননি তিনি। তবে বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিক প্রথম আলো’র জেষ্ঠ প্রতিবেদক শরিফুল হাসান নাসিরনগরে দ্বিতীয় হামলার পর লিখেছেন,
সকাল ৬ টায় ঘুম ভাঙলো নাসিরনগর থেকে পাওয়া একটা ফোনে। গত চারদিন কাজ করতে গিয়ে পরিচয় হওয়া ছেলেটি জানালো এবার আর হামলা নয় আজ ভোর রাতে আরও পাঁচ সাতটি হিন্দু বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি খবরটা শুনে অার মোবাইলে পাঠানো ছবিগুলো দেখে বোবা হয়ে গেছি। তবে অাজকের অাগুন অামার কাছে বড়ই রহস্যময়। এবার ধর্মের সাথে বোধহয় নোংরা রাজনীতির খেলাও শুরু হলো। তবে দুই পক্ষেরই শিকার নিরীহ মানুষ।
সাংবাদিক ও কলামিস্ট ফারুক ওয়াসিফ লিখেছেন,
সাম্প্রদায়িকতা একটা মনোভাব। রাজনৈতিক দস্যুতন্ত্র এই মনোভাবের মুরদ যোগায়। এই দস্যুতন্ত্র গোটা বাঙলাদেশকেই ‘মালাউন’ মনে করে। গুমহত্যায় মানুষ মরে, ঘৃণার আগুনে ঘর জ্বলে আর তারা বলে ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক’!
দস্যুতন্ত্রের ক্ষমতা ছাড়া সাম্প্রদায়িকতার কোনো জোর নাই। একে ক্ষমতা যুগিয়ে যাচ্ছে আপনারেই ভুল চেতনা।
যদি মারতে আসো তবে বলব আমিও মালাউন।যদি মুসলমানের নামে মারতে আসো তাহলে আমিও নাসিরনগরের জামালউদ্দিনদের মতো বলবো, আমিও মুসলমান, আমারে না মাইরা হিন্দুরে মারতে পারবি না!’
একুশে পদক পুরস্কার প্রাপ্ত কবি নির্মলেন্দু গুন তার মুখপঞ্জিতে লিখেছেন,
‘মালাউন’দের ‘বাড়াবাড়ি’
নাসিরনগরে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ক্ষিপ্ত, ক্ষুব্ধ ভাষণে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পূর্ণ মন্ত্রী জনাব ছায়েদুল হক (পশু) সাহেব যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন ছাড়াই ‘মালাউন’দের বিরুদ্ধে ‘বাড়াবাড়ি’ করার অভিযোগ উত্থাপন করেছেন, এটা প্রমাণ করার দায়িত্ব মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেই নিতে হবে। ফিল্ড অাম্পায়ারের সিদ্ধান্তই শেষ কথা নয়। প্রিভিউ এবং থার্ড আম্পায়ার কিন্তু আছেন।
প্রসঙ্গত, গত ৩০ অক্টোবরের ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলায় অজ্ঞাতনামা দুই হাজার ৪০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননাকর ছবি পোস্ট করার অভিযোগে শনিবার গ্রেফতার হওয়া রসরাজ দাসকেও পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। তবে এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ৪ নভেম্বর আবার হিন্দুদের উর হামলা করেছে মৌলবাদীরা।
প্রতিবেদন: তুহিন