
মনিরুল ইসলাম রানা, সহযোগী সম্পাদক:
পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উচ্ছ্বাস বছর জুড়ে উন্মাদনায় মাতিয়ে রেখেছে গোটা জাতিকে। সাধারণ মানুষ তো আছেই পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীও এবছর তুলনামূলক বেশি গ্রামের বাড়িতে গিয়েছেন। শৈশবের আঙ্গিনায় নিঃশ্বাস নেওয়ার আনন্দ এবছর দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ সব চেয়ে বেশি নিয়েছে।
এমন নির্মল ব্যক্তিগত অনুভূতি বাদ দিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে তাকাই পদ্মা সেতুর ফলে ‘দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে ১ দশমিক ৭ শতাংশ এবং জাতীয়ভাবে শূন্য দশমিক ৫৬ শতাংশ জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে।’ – এমন আভিধানিক তথ্য তো আমাদের কাছে ছিলোই, বছর শেষের বাস্তবতা তাহলে কী ?

পেছনে ফিরে দেখা যাক ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ মংলা বন্দর কর্তারা গণমাধ্যমে জানায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ জুলাই থেকে ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ৪০ লাখ ৪৮ হাজার টন পণ্য রপ্তানি ও আমদানি করা হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৭৭ শতাংশ বেশি।
গত অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি ছিল প্রায় ২২ লাখ ৮৮ হাজার টন। মংলা বন্দর দ্বিগুণে পৌঁছেছে মানে সব কিছুর দৃশ্যপট, গতি ও রুপরেখা পাল্টেছে।
তথ্য বলে ২৬ জুন সর্বসাধারণের জন্য পদ্মা সেতু খুলে দেওয়ার পর প্রথম দিনে প্রায় ৫১ হাজার গাড়ি পারাপার হয়েছিল।
মানুষের আগ্রহ দেখে সেতু বিভাগ করোনার আপডেটের মত পদ্মা সেতুর দৈনিক যানবাহন চলাচল ও টোল আদায়ের তথ্য প্রকাশ শুরু করে, প্রথম ৩০ দিনের তথ্য বলে পদ্মা সেতু দিয়ে ছয় লাখের বেশি যানবাহন পারাপার হয়েছিলো, এসব যানবাহন থেকে টোল আদায় হয়েছিলো ৭৬ কোটি টাকার বেশি।
নির্মাণের আগে যানবাহন চলাচল ও আয়ের যে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল, প্রথম মাসের চিত্র তার কাছাকাছি ছিল।
সমীক্ষা বলে, জিডিপির ১ দশমিক ২ শতাংশ টাকার অঙ্কে প্রাপ্তির পরিমাণ হবে ৩৩ হাজার ৫৫৬ কোটি ৫৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা, যা পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়ের চেয়ে বেশি।
পদ্মা বহুমুখী সেতুর প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম সর্বশেষ জানিয়েছিলেন, সার্বিক নির্মাণব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। আর জাইকার ভবিষ্যৎ বানী ছিলো জিডিপি বাড়বে ১ দশমিক ২ শতাংশ, পদ্মা সেতু দিয়ে প্রতিদিন ২১ হাজার ৩০০ যানবাহন চলাচল করবে, ২০২৫ সাল নাগাদ এ সংখ্যা বেড়ে হবে ৪১ হাজার ৬০০।
জাইকার সমীক্ষা ঠিক থাকলে ২০২৫ সালে জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৪ শতাংশ;
পদ্মা সেতুর কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি প্রধান প্রয়াত প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী লিখেছিলেন;
” এই পথটি ট্রান্স-এশীয় রেলপথের অংশ হবে। তখন যাত্রীবাহি ট্রেন যত চলবে, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি চলবে মালবোঝাই ট্রেন। ডাবল কন্টেইনার নিয়েও ছুটবে ট্রেন। তখন পুরো দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে ”
এর মধ্যে পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেস হাইওয়ের পাশে শিবচর উপজেলার কুতুবপুর ও কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়নের বড় কেশবপুরে ৭০ দশমিক ৩৪ একর জায়গায় নির্মিত হচ্ছে শেখ হাসিনা ইনস্টিটিউট অব ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি।

পদ্মা সেতুর মহাদেশীয় আঞ্চলিক প্রভাব নিয়ে বিশ্বের গণমাধ্যমগুলি বেশ বড় করে শেখ হাসিনার প্রশংসা করেছিলো, নিউইয়র্ক টাইসের এক নিবন্ধে লেখা হয়েছিল;
‘ক্ষমতা রাখার প্রতিযোগিতায় পৃথিবীর অধিকাংশ রাজনীতিবীদরা যে নিজে বাঁচো নীতিতে চলে শেখ হাসিনা তার তোয়াক্কা করেনি, রিস্ক তিনি নিয়েছিলেন এবং এখন তিনিই বাংলাদেশের নব অর্থনীতির সব চেয়ে সাহসী নাম ‘
আরটি লিখেছিল ‘গোটা পৃথিবীতে বাংলাদেশ একটি নতুন পারসোনালিটি নিয়ে নিজেদের নব উদ্যমে তুলে ধরলো শেখ হাসিনার হাত ধরে।’
এ লেখাটি লেখার সময় অফিসের একজন জানালেন ভাঙ্গা থেকে পরীক্ষামূলক ট্রেন গেল পদ্মা সেতুর কাছে; এত পরিসংখ্যানের পরে এবার বিরোধীরাও ইনিয়ে বিনিয়ে মানছেন শেখ হাসিনার হাত ধরে বিদায়ী ২০২২ সাল ছিল স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বছর; মংলা বন্দর, পায়রা বন্দর ও এনার্জি হাব, ইপিজেড, রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বরিশাল-পিরোজপুরে শিপ বিল্ডিং শিল্পসহ সার্বিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে।
বছর শেষে পায়রা ও মংলাবন্দর, বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং বন্দর নগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। দেশ জুড়ে একটি সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয় পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতিই আমূল বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা দৃশ্যমান।
বছরের শেষ চমক ছিলো ভারতীয় উপমহাদেশের তৃতীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো চালু হওয়া যাত্রীবাহি উড়াল মেট্রোরেল। নগর যোগাযোগে নতুন দিগন্ত, পদ্মা সেতুর পর মেট্রো রেল চালুর মাধ্যমে রাজধানীর যানজট কমার পাশাপাশি রাজস্ব আহরণ বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
২৮ ডিসেম্বর বেলা ১১টা ০৫ মিনিটে বহুল প্রতীক্ষিত দেশের প্রথম মেট্রোরেলের ফলক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেল উদ্বোধন ঢাকা মহানগরবাসীর বহু প্রতীক্ষিত স্বপ্ন।
মেট্রোরেল উদ্বোধনের ফলে একই সঙ্গে প্রযুক্তিতে চারটি মাইলফলক ছুঁয়েছে বাংলাদেশ। প্রথমত, মেট্রোরেল নিজেই একটি মাইলফলক। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ প্রথম বৈদ্যুতিক যানের যুগে প্রবেশ করলো। তৃতীয়ত, মেট্রোরেল রিমোট কন্ট্রোল যান, যেটি স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের একটি ধাপ। চতুর্থত, বাংলাদেশ দ্রুতগতিসম্পন্ন যানের যুগে প্রবেশ করলো।
মেট্রো রেল পুরোপুরি চালু হলে ঘণ্টায় ৬০ হাজার এবং দিনে পাঁচ লাখ যাত্রী যাতায়াত করতে পারবে। ছয়টি কোচসংবলিত প্রতিটি একমুখী মেট্রো ট্রেন প্রতিবারে সর্বোচ্চ দুই হাজার ৩০৮ জন যাত্রী পরিবহন করতে পারবে।
২০১৮ সালে পরিচালিত বুয়েটের একটি সমীক্ষা অনুসারে, ঢাকা শহরের যানজটের জন্য বার্ষিক ৪.৪ বিলিয়ন ডলার খরচ হয় যা জাতীয় বাজেটের ১০ শতাংশ এর বেশি। ২০১৭ সালের বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকায় যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩.৮ মিলিয়ন কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। নষ্ট কর্মঘণ্টার মূল্য বিবেচনায় নিলে ক্ষতির পরিমাণ জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে।
গবেষকদের মতে, ঢাকার যানজট ৬০ শতাংশ কমাতে পারলে বাংলাদেশ ২.৬ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হতে পারে। জাইকার তথ্য বলে, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ঢাকা শহর যানজটের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার পাশাপাশি বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে, যা দেশের মোট রাজস্বের ১৭ শতাংশ এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ দশমিক ৫ শতাংশের সমান।
মেট্রোরেল প্রকল্প ঢাকা শহরকে বর্তমান অবস্থা থেকে আধুনিক কসমোপলিটনে রূপান্তর করবে। বাংলাদেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে ভবিষ্যতে উন্নত বিশ্বে পদার্পণ সময়ের ব্যাপার মাত্র। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে ‘মেট্রো রেল’ প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) দ্বারা অনুমোদিত হয়, পরিকল্পনা থেকে তদারকির পুরোটায় যুক্ত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং নিজে প্রথম যাত্রী হয়ে বাংলাদেশের গণপরিবহন ব্যবস্থার নব যুগের সূচনা করলেন।
বিদায়ী ২০২২ সাল ছিল স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বছর, যার সাক্ষী হয়ে রইলাম আমরা ও সময়।