
ডেস্ক: বাংলার মরমী গান ও ভাব সঙ্গীতের জগতে যাদের আত্মত্যাগ এবং অবদান অনস্বীকার্য, তাদের মধ্যে পাঞ্জু শাহ্ অন্যতম। লালন শাহ্’র শিষ্যস্থানীয় হলেও তিনি আদৌ লালনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন কিনা তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বাংলা মরমী গানের জগতে লালন শাহ্’র পরেই তার স্থান। পাঞ্জু শাহ্ রচিত গানগুলোকে আল্লাহতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, রাসূলতত্ত্ব, মুর্শিদতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, মানবতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, সংসার ও সমাজতত্ত্ব, খেরকাতত্ত্ব, গোষ্ঠ ও অষ্টতত্ত্ব ইত্যাদি শ্রেনিবিভাগে বিভাজিত করা যায়।
পাঞ্জু শাহ্ ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দের ১২ অগাস্ট (বাংলা ১২৫৮ সনের ২৮ শ্রাবণ) ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার হরিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা খাদেম আলী খোন্দকার পাঠানবংশীয় জমিদার হওয়া সত্যেও ধর্মের প্রতি একান্ত অনুরাগের কারণে সংসারের প্রতি উদাসীন ছিলেন।
ফলে জমিদারি ও ধন-সম্পদ সবই হারাতে হয়। পারিবারের ধর্মীয় রক্ষণশীলতার কারণে পাঞ্জু শাহ্কে বাল্যকালে আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষা শিখতে হয়। কিন্তু বাংলা ভাষার প্রতি প্রবল আগ্রহের কারণে তিনি নিজ চেষ্টায় বাংলা শেখেন। ভূ-খন্ডের লোকজ সংস্কৃতি, সুফিবাদ ও আধ্যাত্মবাদ তাকে শৈশব থেকেই আকৃষ্ট করত। কৈশোরে তিনি হরিশপুরের সুফি সাধক হিরাজতুল্লাহ খোন্দকার’র শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং সুফিগান রচনা করতে শুরু করেন।
“আল্লাহ মুহাম্মাদ আর আদম
তিনজনা এক দমে চলে
দম চিনে নাও দমের মালা গলে।”
ঈশ্বরবেশী মানুষ অথবা মানুষবেশী ঈশ্বরকে খুঁজে বেড়াতে রাস্তায় নামেন পাঞ্জু শাহ্। খুঁজে বেড়ান আপন গুরু, আপন মুর্শিদকে। জীবনযাত্রার এক পর্যায়ে লালন শাহ্’র আখড়ায় এসে স্থির হন তিনি। গানে গানে লালন শাহ’র উত্থাপিত দু’টি প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম হওয়ায় পাঞ্জু শাহ্কে বুকে জড়িয়ে নেন মহাত্মা লালন।
কথিত আছে, পরবর্তী বাউল সমাজের নেতা হিসেবে পাঞ্জু শাহ্কে মনোনীত করেন লালন সাঁই। লালন শাহ’র সান্নিধ্যে ফকিরি গ্রহণ করলেও জন্মরোধের সাধনা থেকে বিরত থাকা ও সংসারত্যাগী না হওয়ার কারনে লালন শাহ্’র জীবন দর্শনের সাথে পাঞ্জু শাহ্’র জীবন দর্শনে বিভেদ সৃষ্টি হয়। তাই জীবদ্দশায় বা গানের কথায় ভনিতার ছলেও কখনো নিজেকে বাউল বলে দাবি করেনি সচেতন পাঞ্জু শাহ্। উপরন্তু, গুরু হিরাজতুল্লাহ’র দর্শনগত দিক থেকে পাঞ্জু শাহ্ চিশতিয়া ও নিজামিয়া ভাবধারা ধারণ করতেন।
১৮৯০ সালে প্রকাশিত নিজ কাব্যগ্রন্থ ‘ছহি ইস্কি ছাদেকী গওহোর’ (সত্যিকারের প্রেম) সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এ কিতাব ইমানেতে যে জন পড়িবে! আল্লার যে ভেদ সেই অবশ্য পাইবে।’ এই কাব্যগ্রন্থে তিনি সুফিতত্ত্বের মর্মকথা ও সেই ভাবাদর্শে জীবন যাপনে প্রয়োজনীয় নৈতিক উপদেশ রেখে গেছেন।
পাঞ্জু শাহের শিষ্যগণের মধ্যে রহিম শাহ, আরমান শাহ, হায়দার শাহ, সদয় শাহ, আনার শাহ, হিরু শাহ, মাতাম শাহ, জুম্মন শাহ, আঁধারী শাহ, ফিকির শাহ অন্যতম।
১৯৯০ সালে প্রকাশিত, ড. খোন্দকার রিয়াজুল হক রচিত ‘মরমী কবি পাঞ্জু শাহ: জীবন ও কাব্য’ নামক গবেষণা গ্রন্থে পাঞ্জু শাহ্’র দুই শতাধিক গান সংকলিত আছে।
১৩২১ বঙ্গাব্দের ২৮ শ্রাবণ (১২ আগস্ট, ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ) জন্মস্থান হরিশপুরেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন পাঞ্জু শাহ্। সেখানেই দুই স্ত্রী চন্দন নেছা ও পাঁচি নেছা’র কবরের মাঝখানে চিরনিদ্রায় শায়িত এই মরমী সাধক। পাঞ্জু শাহ্’র মাজারটি কেন্দ্র করে ভক্ত ও অনুসারীরা বছরে দু’বার মচ্ছব এবং একবার ওরশ ও জলশার আয়োজন করে থাকে।
পাঞ্জু শাহ্’র ১৬৫ তম জন্মবার্ষিকী এবং একই সাথে ১০২ তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে, শ্রদ্ধাভরে তাকে স্মরণ করে নিউজনেক্সটবিডি ডটকম পরিবার।
নিউজনেক্সটবিডিডটকম/এসকেএস/এসজি