
অবন্তি মাহমুদ;
আজকের এই ঘূর্ণিঝড়ের সময় কিসের টানে বা কেন এই লেখাটি লিখছি বুঝে উঠতে পারছি না লেখাটা আদৌ কি ঠিক তাও আমি জানি না,তাঁকে নিয়ে লেখার মত যোগ্যতা না থাকার পরও আমি নিজেকে আটকাতে পারছি না কোনোভাবেই কোথা থেকে একটা টান আসছে ভিতরে যে লিখো।
এই ছবিটা আমি আমার জন্মের পর থেকে নানাভাইয়ের ঘরের দেয়ালে টানানো দেখে আসছি প্রথম থেকেই আমার মাথায় ঘুরতো যে এটা বোধহয় মামার ছবি এখানে একটু বলে রাখি যে মামার জন্য নানাভাইয়ের একটা অদ্ভুত দুর্বলতা ছিল যেটার কারণেই ভাবতাম এটা হয়ত মামারই ছবি।আমি আজকে যাই লিখছি সেটা পুরোটাই আমার মায়ের কাছ থেকে শোনা আর ২০১৭ তে সৌম্য ভাইয়া এই মানুষটির স্মরণে একটা লেখা লিখেছিল সেটা থেকে নেয়া। এই মানুষটির সাথে পরিবারের সবাই মা খালারা পরিচিত হলেও আমরা ছোটরা অতটা পরিচিত নয় পিচ্চিগুলো আসলে জানারও কথা না যেখানে আমিই কিছু জানি না মানুষটা সম্পর্কে ওরা তো আমার থেকে অনেক ছোট।

যাই হোক লেখাটা আমার শুরু করতে একটু সময় লেগে যাচ্ছে আসলে লেখালেখি ব্যাপারটা ভেতরে নেই তাই হয়ত। ছবির এই মানুষটি হচ্ছেন আহমেদুর রহমান যাকে হয়ত অনেক মানুষ চিনেন ভীমরুল নাম, সম্পর্কে আমার নানাভাই হাবিবুর রহমান মিলনের অনুজ। আজকে তাঁর ৫৫তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে নিয়ে আমি লিখছি এটা আমি কখনই ভাবিনি। ৬৫-তে কায়রোতে বিমানের উদ্বোধনী ফ্লাইটে সাংবাদিক প্রতিনিধি দলের হয়ে যাবার পথে আকাশে প্লেন ক্রাশে তাঁর মৃত্যু হয় তাঁর সাথে আরও ২১জনের দেহাবশেষ পাওয়া যায় নি তাঁর দুই সন্তান বাবাকে বাবা বলে বোঝার আগেই তিনি চলে গেলেন, তাঁর মেয়ের বয়স বোধ হয় তখন কয়েকমাস এরপর সংসারের হাল ধরলেন আমার নানাভাই। সৌম্য ভাইয়ার লেখাটায় পড়েছিলাম যে ঐ নানার সাপ্তাহিক কলাম পড়ার জন্য নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালের সামনে সাটানো পত্রিকার সামনে মানুষের ভীড় লেগে থাকত। আমি যখন ক্লাস এইট বা নাইনে তখন মেঝো খালার জোরাজুরিতে আমি আর অজন্তা শিশু সাংবাদিকতার উপর একটা ট্রেনিংয়ের জন্য পি আই বিতে গিয়েছিলাম যদিও বাসায় এত এত অসাধারণ কিছু সাংবাদিকদের দেখার পরও পেশাটায় তেমন আগ্রহ ছিল না তখন পি আই বির চেয়ারম্যান মনে হয় নানাভাই ছিলেন নানাভাই ব্যক্তিজীবনে কিছুটা উদাসীন হওয়াতে ট্রেনিংয়ে আমাদেরকে চিনতে পারেন নি তো ট্রেনিং শেষ হওয়ার পর আমরা নানাভাইয়ের রুমে গেলাম দেখা করতে সেখানে তখন নানাভাইয়ের সাথে তাঁর সহকর্মীদের আড্ডা চলছিল আমরা যাওয়ার পর তখন সে আমাদেরকে চিনতে পেরে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন এর মধ্যে কোনো একজন নামটা মনে করতে পারছি না এই মূহুর্তে বলছিলেন এই মেয়ে দেখতে শুনতে গড়নে তো অবিকল মিলন ভাইয়ের মত হইসো, দুই নানার মত মানুষ হও এই দোয়া করে দিলাম ওইদিন বাসায় ফেরার সময় গাড়িতে মাথায় ঘুরছিল দুই নানা?? তারপর যদিও বাসায় এসে ভুলে গিয়েছিলাম ব্যাপারটা কেন জানি আবার কিছুদিন পর আব্বুকে আম্মুর সাথে কথা বলতে শুনছি যেখানে বারবার ভীমরুল শব্দটা কানে আসছে আমি আম্মুকে এরপর জিজ্ঞেস করলাম এই ভীমরুল মানে কি তোমরা ভীমরুল ভীমরুল কেন করছিলে?
শুরুতেই যদিও ধমক দিল সম্মান দিয়ে কথা বল এটা তুমি যা ভাবছ তা না এরপর আস্তে আস্তে উঠে আসল অনেক অজানা কথা আমি যখন শুনছিলাম মনে হচ্ছিল কোনো গল্প এটা, এটা কিভাবে বাস্তবে হয় আমাদের পরিবারে এরকম কিংবদন্তীতূল্য একজন আছেন যাকে নিয়ে জানিই না কিছু আমরা আমার মাও যদিও বেশি কিছু জানতেন না এরপর আস্তে আস্তে এই নানার জীবনটা আমার কাছে রহস্যের মত লাগত কিন্তু কাউকে কখনও জিজ্ঞেস করার সাহস হয় নি একটা ভয়ও কাজ করত।
২০১৭ আমার জীবনের পার করা সবচেয়ে অদ্ভুত বছর যতসব অদ্ভুত অকল্পনীয় পরিস্থিতি হতে পারে সব হয়েছিল ওই বছর বছরটা আমি মনে করতে চাই না তাই কোনোভাবেই তো ওই বছরই মে মাসে সম্ভবত ২১ তারিখ সৌম্য ভাইয়া এই নানাকে নিয়ে স্ট্যাটাস দিলো আবার সেই রহস্য শুরু হয়ে গেল লেখাটা আমি প্রতিবছর ভাইয়ার টাইমলাইনে স্ক্রল করে বের করি এই দিনে পড়ার জন্য আমি এটা বলতে চাই নি কখনও যাই হোক বলে ফেললাম।

ঐ লেখাটায় আহমেদুর রহমানের স্মৃতিচারণে নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী নাকি বলেছেন- “জটিল ধরনের একটি বিদেশি সংবাদ শিরোনামসহ তাকে তৈরী করতে বলেছিলাম।স্থান,তারিখ,প্রকাশভঙ্গি কিছুই থাকে বলা হয়নি ,বিশ মিনিট পর আহমেদ লেখাটা আমার হাতে দেয় অভিধানটিও সে একবার খোলেনি।সংবাদটি একদমে আগাগোড়া পড়ে গেলুম।শব্দ -চয়ন,প্রকাশভঙ্গি,সাবলীলতা দেখে বিশ্বাসই হতে চায় না কেবল প্রবেশিকা পাশ হতচ্ছাড়া গোছের ছেলেটিই সেটা তৈরি করেছে এবং তাও এতটা অনায়াসে।”
তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়েছিল দৈনিক মিল্লাত এর মাধ্যমে তাঁর আগে রেডিওতে নাকি কিছুদিন কাজ করেছেন এরপর ইত্তেফাকে যোগ দেন যোগ দেয়ার পূর্বে নাকি তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে শর্ত দিয়েছিলেন যে উনাকে একটা কলম দিতে হবে উনি স্বাধীনভাবে লিখবেন।সেখানেই জন্ম হয় ভীমরুলের, শুনেছি তাঁর মৃত্যুর পর নাকি অনেক চিঠি এসেছিল ইত্তেফাকে যাঁরা জানতেন না যে ভীমরুল কে, দেখতে কেমন শুধু জানতেন ভীমরুল আর নেই।
৬১-তে রবীন্দ্র শতবার্ষিকীর উদযাপন কমিটিতে ছিলেন তিনি, ওয়াহিদুল হক (আম্মুদের হলুদ কাকা),মোখলেসুর রহমান ।এর সূত্র ধরেই সূচনা হয় ছায়ানটের। পাঁচজন প্রতিষ্ঠাতার একজন আমার এই নানা। ৬২-র ছাত্র আন্দোলনের তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে নাকি কমরেড ফরহাদ বিস্তর ব্যাখ্যা দিয়েছেন সম্ভবত ভীমরুলের রচনাবলি বইটিতে।এই নানাকে নিয়ে আসলে যা জানি সব ভাইয়ার লেখা থেকেই আমার জানা, উনি নাকি বলতেন- “আমি পেশায় সাংবাদিক, চিন্তায় বামপন্থী, কর্মে অলস,ভবঘুরে।”
এই লাইনটিই মূলত প্রতিবছর সৌম্য ভাইয়ার টাইমলাইন চুপিচুপি স্ক্রল করার মূল কারণ আমার। এই লাইনটিতে কি আছে আমি জানি না এটা আমার প্রিয় কি না তাও জানি না থাকুক এটা রহস্য এরকম ঘোরে থাকতে খারাপ লাগে না আসলে।
অনেক বিস্তর একটা লেখা উপরে কি লিখেছি, কেন লিখেছি কিছু জানি না আমি এটা আরেকবার পড়ে কোনো সংশোধনও করতে চাই না। আমি শুধু এটুকু জানি উনি আজকে বেঁচে থাকলে সবকিছুই অন্যরকম হত।যার জীবনকাল এতটা সংক্ষিপ্ত মাত্র বত্রিশ বছরের আর এই বত্রিশটা বছরের কর্মকান্ড যখন আমাকে এত টানে উনি আজকে বেঁচে থাকলে কি হত কে জানে …
অবন্তি মাহমুদ , আহমেদুর রহমানের দৌহিত্রা