
মাসকাওয়াথ আহসান: কলকাতায় যে বাঙালি রেনেসাঁ ঘটেছিলো; তা ছিলো ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের ওপরে মানুষ আত্মপরিচয়কে মেলে ধরার প্রয়াসে। ব্রাহ্ম সমাজ শিল্প-সাহিত্য চর্চার মাঝ দিয়ে একটি উদার সাংস্কৃতিক ঐক্য রচনার চেষ্টা করেছিলো। এই উদারপন্থার রেলগাড়িতে চড়ে অবিভক্ত বাংলার যেসব তরুণ-তরুণী সংগীত ও বেতার নাটক শুনতে, খবরের কাগজ পড়তে বা ফিল্ম দেখতে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলো; তারাই আবদ্ধ চিন্তার পাতকূয়া থেকে মুক্তচিন্তার সমুদ্রে অবগাহন করতে পেরেছিলো। এরাই বাঙালি রেনেসাঁর চিহ্ন। এদের সংখ্যা ছিলো কম। ফলে তাদের উত্তর-পুরুষের সংখ্যা কম। যে কারণে কলকাতার বাঙালি রেনেসাঁর অভিঘাত সমাজে দৃশ্যমান নয়। সমানুপাতিক সাংস্কৃতিক প্রগমন না ঘটায় সাংস্কৃতিক দারিদ্র্য সীমাহীন। আমরা প্রচলিত অর্থে দারিদ্র্য দূরীকরণ বলতে সম্পদের সুষম বন্টন বুঝি। কিন্তু মানবসম্পদ তৈরীতে সাংস্কৃতিক সুষমবন্টন অত্যন্ত জরুরী।
জাপানের শিক্ষা ব্যবস্থার গোড়ার চিন্তা ছিলো জীনগতভাবে তিন প্রজন্মের মুক্তচিন্তার মানুষ তৈরী করা। শিক্ষাব্যবস্থার মাঝ দিয়ে জাপানে একটি সাংস্কৃতিক রেনেসাঁ ঘটে গেছে সামষ্টিকভাবে। জার্মানী ও ক্যানাডার শিক্ষা ব্যবস্থাতেও জীনগত উতকর্ষ সাধনের মাধ্যমে সুশৃংখল জাতি গঠনের প্রয়াস রয়েছে। কিন্তু বাঙালি সমাজে রেনেসাঁর চেষ্টাটি শিক্ষাব্যবস্থাকেন্দ্রিক না হওয়ায়; ছোট ছোট সাংস্কৃতিক সংগঠন কেন্দ্রিক হওয়ায়; মুক্তচিন্তার খন্ডিত বিকাশ ঘটেছে। বেশীর ভাগ মানুষই রয়ে গেছে চিন্তার আদিম স্তরে। যে কারণে বাঙালি সমাজে পিছিয়ে পড়া মনোভঙ্গির দাপট তৈরী হয়েছে বাঙালি রেনেসাঁর আলোকে ম্লান করে দিয়ে। সেকারণে অতীতের চেয়ে বর্তমান পিছিয়ে পড়েছে চিন্তায় ও মননে। তাই এই মুহূর্তে সমস্ত মনোযোগ নিবদ্ধ করা প্রয়োজন শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে। নইলে ধনাঢ্য অথচ সাংস্কৃতিক দৈন্যে লীন অনগ্রসর জনগোষ্ঠী হিসেবে এ সমাজের নিমজ্জন অবশ্যম্ভাবী।
লেখক: প্রবাসী সাংবাদিক ও ব্লগার