
মাসকাওয়াথ আহসান:
হুমায়ূন আহমেদের বাকের ভাই ও বদি সময়ের বিবর্তনে জনপ্রতিনিধি হয়ে ওঠে। বাকের ভাই সংসদের লাউঞ্জে বদিকে ডেকে বলেন, তোমার নামে অনেক অভিযোগ বদি। আমি আহত হয়েছি এসব শুনে। আশা করেছিলাম জনপ্রতিনিধি হবার পর সমঝে চলবে।
বদি মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থেকে বলে, এসব মিডিয়ার সৃষ্টি। বিশ্বাস না হয় মুনা আপাকে জিজ্ঞেস করুন।
বাকের ভাই মুনা আপাকে ফোন করেন। ফোন বাজে কিন্তু ধরে না।
স্বগত উক্তির মতো বলেন, ফোন ধরে না কেন!
বদি বলে, বোধ হয় ঘুমাচ্ছেন।
–মুনা ঘুমাচ্ছে কীনা তা তুমি জানবে কী করে!
বদি হেসে বলে, মুনা আপার রাতে ঘুমের অসুবিধা হয়। আমি ছোট বেলা থিকা একটু হেকিমি শিখছি; তাই উনারে একটু ওষুধ দিছিলাম।
বাকের ভাই বিরক্ত হয়ে বলেন, থিকা নয় থেকে বলবে। অপ্রমিত উচ্চারণ বড্ড কানে বাজে।
বদি মুখ কাঁচুমাচু করে বলে, ইলেকট্রিক মিডিয়া আমার পিছে লেগেছে বাকের ভাই।
–ইলেকট্রিক মিডিয়া নয়, ইলেকট্রনিক মিডিয়া; ভুল ইংরেজি বলার চেয়ে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলা শ্রেয়।
–শুদ্ধ বাংলা ইংরাজির চেয়েও কঠিন লাগে বাকের ভাই।
–শোনো এই শেষবার বলছি তোমাকে; সাবধান হয়ে যাও। তোমার এলাকায় সরজমিন তদন্তে যাচ্ছেন দলের সাধারণ সম্পাদক। তোমার অপরাধ ধরা পড়লেই তোমার ছুটি; আবার জেলে যেতে হবে তোমাকে।
বদি খিল খিল করে হেসে বলে, উনারে আসতে দেন এলাকায়; উনি টের পাইবো বদি আর বদি নাই; সে এখন বদি দেবতা।
–তার মানে!
–আমাদের সমাজে তো বিচার-আচার নাই, শান্তি নাই বাকের ভাই। তাই মানুষ আমার কাছে আসে; সাধ্যমত চেষ্টা করি।
–কী চেষ্টা করো!
–বিচার কইরা দিতে, একটু শান্তি দিতে!
–শান্তি দাও কীভাবে! আমি তো পাতার পর পাতা রবীন্দ্রনাথ পড়েও শান্তির দেখা পাইনা।
–শান্তি নিবেন বাকের ভাই; মুনা আপা তো আমার কাছ থিকা নিছেন।
–না থাক; আমি এখন আসি।
সকাল সকাল বিশাল এক গাড়ি এসে থামে সমুদ্রের পাশে বাজারে।
বদি দৌড়ে আসে রসগোল্লা আর নিমকির প্লেট হাতে।
দলের সাধারণ সম্পাদক বলেন, যতই আপ্যায়ন করো; আমি কিন্তু সত্য অনুসন্ধানে এসেছি।
কোন অসুবিধা নাই স্যার; সত্য আমার বেয়াই; ঘনিষ্ট লোক।
সাধারণ সম্পাদক বলেন, তুমি এখানেই থাকো। আমি একটু এলাকাটা ঘুরে আসি।
সাধারণ সম্পাদকের গাড়ির ড্রাইভার স্টিয়ারিং-এ মোচড় দিয়ে ভট ভট শব্দ করে চলে যায়।
সাধারণ সম্পাদক এক পথচারীকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, এই শোনো, বলোতো বদি কেমন লোক!
–বদি না বদি দেবতা বলেন। দেবতা যেমন হয়; উনিও তেমনি; এর বেশি আমি কিছু জানিনা।

A view of Saint’s Martin Island from the sea – Photo by Nazrul Islam
গাড়ি এগিয়ে যেতে যেতে চায়ের স্টলের বেঞ্চিতে ঘুমিয়ে থাকা এক লোককে ঘুম থেকে তুলে সাধারণ সম্পাদক জিজ্ঞেস করেন, এই দিনের বেলায় ঘুমাও কেন! বদি কেমন লোক!
লোকটা আড়মোড়া ভেঙ্গে বলে, বদি দেবতাই আমার নিদ্রা দেবতা; আগে ঘুম হইতো না স্যার। বদি দেবতা আমারে ঘুম আইনা দিছে। ভোটের দিন ঘুম থিকা উঠতে পারলে অবশ্যই উনারে ভোট দেবো।
সাধারণ সম্পাদকের মনে হয়, ঘুমের ঘোরে ভুল বকছে লোকটা।
গাড়ি এগোতে থাকে; একদল চ্যাংড়া ছেলেকে থামিয়ে উনি জিজ্ঞেস করেন, বদি কেমন লোক!
ছেলেরা সমস্বরে উত্তর দেয়, বদি দেবতা আমাদের জীবনে শান্তি এনেছেন, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। আমরা ঘরে ঘরে শান্তি পৌঁছে দিই।
–শান্তি পৌঁছে দাও মানে!
–মানে বুঝি না; উনি আমাদের দেবতা।
সারাদিন ফ্যাঁ ফ্যাঁ করে ঘুরতে ঘুরতে সম্পাদক ক্লান্ত হয়ে পড়েন। বদিকে তুলে নিয়ে একটু চা খেতে যান।
বদি অনুনয় করে, স্যার আমি তো চা খাইনা স্যার; বিশ্বাস করেন, চা-পান-সিগারেট স্পর্শ করিনি কখনো।
সম্পাদক বিস্মিত হন। চায়ের দোকানিকে জিজ্ঞেস করে, বদি কী চা-ও খায় না।
সে বদির চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, বদি দেবতা চা খায় না। শুধু দরিয়ার হাওয়া খায়।
সম্পাদক বলেন, চা খেলে কিছু হয় না বদি; আমার সম্মানে একটু খাও।
বদি কাঁচুমাচু মুখ করে সুড়ুত সুড়ুত করে চা খায়।
রাতে সার্কিট হাউজে ফিরে সম্পাদক বলেন, ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু। বুঝলে বদি, এতো ক্লান্তি তবু ঘুম কিছুতেই আসেনা। শান্তি পাইনা।
–স্যার আপনি ডিনার কইরা নেন; আমি আপনারে একটু শান্তি আইনা দিতাছি।
এরপর কী হয় সাধারণ সম্পাদক সকালে উঠে মনে করতে পারেন না। শুধু মনের মধ্যে একটা ভালো লাগা কাজ করে; অনেক দিন পরে সাউন্ড স্লিপ হয়েছে।
সার্কিট হাউজের বাগানে হাঁটতে গেলে বদি একটি ফুলের মালা নিয়ে আসে। উনাকে পরিয়ে দেয়। উনি খুশি হয়ে বলেন, তুমিও পরে নাও। একথা বলতেই একদল মানুষ বদি দেবতা অমর হোক শ্লোগান দিতে দিতে বাগানে এসে বদিকে ফুলের মালা পরিয়ে দেয়।
সাধারণ সম্পাদক বদির জনপ্রিয়তায় মুগ্ধ হয়ে বলেন, বদির কোন বিকল্প নেই।
লোকগুলো সমস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে, জয়, বদি দেবতার জয়।
সাধারণ সম্পাদক গাড়িতে উঠে বিদায় জানিয়ে চলে যেতেই সার্কিট হাউজে প্রবেশ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গাড়ি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বদিকে নিয়ে রুদ্ধদ্বার কক্ষে গিয়ে বলেন, তোমার নাম গডফাদারদের তালিকায় এসেছে; আমাকে সত্যি কথাটা বলো; কিছু গোপন করবে না।
বদি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। বলে, আমাদের কয়েক পুরুষের ব্যবসা স্যার। আমি বার্মা থেকে বৈধ উপায়ে নানারকম গাছগাছালি নিয়ে এসে বিক্রি করি। তার জন্য ট্যাক্স দিই। আমার জনপ্রিয়তাকে হিংসা করে বিরোধী শিবিরের লোকেরা; তাদের সঙ্গে সরকারি কর্মচারিদের ঘনিষ্টতা আছে। তারাই ষড়যন্ত্র করে তালিকায় আমার নাম দিয়েছে।
–শুধু তুমি না তোমার ভাই-বেয়াই; এদের নামও তালিকায় আছে।
–স্যার আমার ভাই সর্বোচ্চ করদাতা ব্যবসায়ী। সে সি আইপি হয়েছে। আর বেয়াই-এর কথা বলতে পারিনা স্যার। বড়লোক কাউরেই তো বেয়াইয়ের কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহি করতে দেখিনা। গরীবের বেয়াই নিয়া লাগলেন কেন স্যার!
–তাহলে তুমি বলছো তুমি গড ফাদার নও।
–স্যার এলাকার মানুষরে যেহেতু শান্তি দেই; তাই তারা তাদের বাচ্চা হইলে আমার কাছে নিয়া আসে; আমি দরিয়ার পানিতে নবজাতকদের গোসল দিয়া দিই; এইজন্য কী আমারে গডফাদার বলবেন স্যার!
–তোমার এলাকায় এতো মাদক-ব্যবসা; তুমি কোন ব্যবস্থা নেওনা কেন!
–ওরা আমারে জমের মত ভয় করে; আমি এলাকায় থাকলে তারা সাম্পান নিয়া পলাইয়া যায়। আর আমি থাকলে শান্তির সরবরাহ অবাধ থাকে; ফলে কেউ মাদক-ব্যবসায়ীদের কাছে শান্তি কিনতে যায়না। কিন্তু আমি ঢাকায় থাকলে শান্তি সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে। তখন ওরা সাম্পানে কইরা বার্মা থিকা শান্তি নিয়া আইসা বেচে।
–তো এসব কথা মিডিয়ায় বলো না কেন! অযথা মানুষ তোমাকে ভুল বুঝে বসে আছে। যাকগে ঘুম আসেনা; তবু চেষ্টা করি। ঘুম থেকে উঠে ভ্যাটিক্যান হাজারির পোপের কাছে যেতে হবে।
–সে তো যেতেই হবে; শান্তির হেফাজত নিশ্চিত করতে ভ্যাটিক্যান হাজারির পোপের কাছে যেতেই হবে।
এরপর কী হয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মনে নেই। তবে অনেকদিন পর প্রাণ ভরে ঘুমিয়ে নেন। ঘুম থেকে উঠে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের বলেন,
বদির বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে; কিন্তু প্রমাণ নেই।
বদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ভ্যাটিক্যান হাজারির পথে এগিয়ে দেয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন, জনতা গাড়ির ওপর ফুলের ক্রসফায়ার করছে আর উল্লাস করছে, জয় বদি দেবতার জয়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনে মনে বলেন, আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে,
কথায় না বদি হয়ে কাজে বদি হবে!

মাসকাওয়াথ আহসান: ব্লগার ও প্রবাসী সাংবাদিক