
রেজাউল করিম, সাভার
দেশের চামড়া শিল্পনগরী হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তরে সরকার ও মালিকদের মধ্যে টানাপড়েন দীর্ঘদিনের। সরকার কারখানা স্থানান্তরের তাগিত দেয় আর মালিকরা ক্ষতিপূরণসহ নানাবিধ দাবি করে। মালিকদের ক্ষতিপূরণ ও সিইটিপি প্রস্তুতের মতো সব সমস্যা তাই এরই মধ্যে দূর করেছে সরকার। সিইটিপি’র পাঁচটি মডিউলের চারটিতেই কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু সরকারের কাজ এগিয়ে গেলেও পিছিয়ে রয়েছে মালিকদের প্লট প্রস্তুতের মতো অবকাঠামোগত নির্মাণ কাজ। ফলে মালিকদের নির্মাণ কাজের ঢিলেমিতে সরকারের বেঁধে দেয়া ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সব কারখানা সাভারে স্থানান্তরের অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকারের কঠোর নির্দেশনার পাশাপাশি কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
সাভার হেমায়েতপুর ট্যানারি পল্লী (চামড়া শিল্পনগরী) সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে, মালিকদের কারখানা স্থানান্তরের প্রধান সমস্যা সরকারের কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার বা সেন্ট্রাল ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (সিইটিপি)’র প্রস্তুতি কাজ শেষ হয়েছে। তার কার্যক্রমও চলছে। গত কুরবাণী ঈদের পর থেকে জমে থাকা বর্জ্য পরিশোধনের কাজ চলছে সেখানে। বর্জ্য শোধনের প্রথম ধাপে পানি অনেকটা ময়লা ও দূর্গন্ধ মনে হলেও চতুর্থ ধাপে এসে অনেকটা দূর্গন্ধ মুক্ত স্বচ্ছ পানি দেখা গেল। পঞ্চম ধাপ পেরিয়ে এই পানি নদীতে ফেলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নদীতে পড়ার আগে এই পানি আবার পরিবেশ উপযোগী কিনা তা পরীক্ষা-নীরিক্ষা করা হবে। বর্জ্য শোধনের এ চক্রে এক সপ্তাহ সময় লাগে।
সিইটিপির নার্মাণ কাজের দায়িত্বে থাকা ঠিকাদার শাহিন আহম্মেদ জানান, চামড়ায় ব্যবহৃত কেমিক্যাল নষ্ট করার জন্য ৫টি মডিউলে ৮টি অক্সিডাইজেশন ডিস্ক রয়েছে। কেমিক্যাল ও বর্জ্য পৃথক হবে এসব ডিস্কের মাধ্যমে। চারপাশে উঁচু দেয়াল, মাঝে পুঁকুরের মতো করে তৈরি এসব অক্সিডাইজেশন ডিস্ক। ট্যানারি থেকে বর্জ্য পাইপলাইনের মাধ্যমে এসে কয়েকটি প্রক্রিয়ায় পরিশোধন করবে অক্সিডাইজেশন ডিস্কগুলো।
ট্যানারি বর্জ্য প্রথমে পাইপলাইনের মাধ্যমে যাচ্ছে ব্রাইটেক্স চেম্বারে। সেখান থেকে রিফাইন হয়ে সলিট চেম্বারে যাচ্ছে। এরপর ইকুলাইজেশন ট্যাংক থেকে যাচ্ছে অক্সিডাইজেশন বক্সে ‘এ’। এরপর অক্সিডাইজেশন বক্স ‘বি’ হয়ে যাচ্ছে স্ল্যাম রিয়েল ট্যাংকে। সবশেষে বর্জ্য যাচ্ছে ডাম্পিং মেশিনে। বিষমুক্ত তরল চলে যাচ্ছে ধলেশ্বরী নদীতে। আর ডাম্পিং এর বর্জ্য দিয়ে তৈরি হচ্ছে বিদ্যুৎ। সাভার চামড়া শিল্পনগরীর চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে যে বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে, তা নিজস্ব পাওয়ার স্টেশন থেকেই মেটানোর চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। এজন্য ৪০ মেগাওয়াটের পাওয়ার স্টেশন প্রস্তুত রয়েছে। চারটি মডিউলের মধ্যে অক্সিডাইজেশন ডিস্ক এ-১, এ-২ ও বি-৩, বি-৪ এর কনন্সট্রাকশন কাজ শেষ করে বসানো হয়েছে মেশিনারি যন্ত্রপাতি। চীন থেকে আমদানি করা পাম্প, প্যাডেল সিস্টেম পাম্প, ডিটক্সাইড বে¬ায়ার (যা দিয়ে বাতাস দেওয়া হয়) এবং ছাকনি বা স্প্রিনিং মেশিনও বসানো হয়েছে। চারটি মডিউলে ২৫ হাজার কিউবিক মিটার বর্জ্য পরিশোধনের সক্ষমতা রয়েছে সিইটিপির।
সাভারের চামড়া শিল্পনগরীর সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে শিল্পনগরীর প্রকল্প পরিচালক ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবদুল কাইয়ুম বলেন, আমরা এরই মধ্যে আমাদের কার্যক্রম প্রায় শেষ করে নিয়ে এসেছি। সিইটিপির কার্যক্রমও চলছে। কারখানা মালিকদের দাবি ছিল বর্জ্য শোধনাগার প্রস্তুত করা। আমরা করেছি। এখন যত দ্রুতই তারা আসবে ততই ভাল। তবে এখন পর্যন্ত ১৬টি কারখানা স্থানান্তরিত হয়েছে। এ সপ্তাহের মধ্যে আরও ৭টি স্থানান্তরিত হবে। আর এ মাসের শেষ দিকে আরও ৭টি কারখানা স্থানান্তরিত হবে বলেও জানান তিনি।
তবে চামড়া শিল্পনগরী স্থানান্তরে মালিকদের প্রধান অজুহাত সরকারের সিইটিপি প্রস্তুত ও এর কার্জক্রম এগিয়ে গেলেও ধীর গতিতে আগাচ্ছে মালিকদের অবকাঠামোগত নির্মাণ কাজ। এখনও কোন কারখানা পরিপূর্ণ স্থানান্তর বা কার্যক্রম শুরু করেনি। ১৬টি কারখানা স্থানান্তর হলেও কারখানাগুলোর একদিকে চলছে প্লট প্রস্তুতের মতো অবকাঠামোগত নির্মাণ কাজ অন্যদিকে চলছে চামড়ার কাজ।
ট্যানারি স্থানান্তরের বিষয়ে জানতে চাইলে ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানারস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) সভাপতি শাহিন আহমেদ বলেন, সিইটিপি চালু হয়েছে এখন স্থানান্তরের বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে মালিকরা। আশা করছি সবাই স্থানান্তরিত হবে। তবে এতো বড় বড় ম্যাশিন ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি নিয়ে খুব দ্রুত ইচ্ছা করলেও যাওয়া সম্ভব হয় না। তার ওপর আবার অপেক্ষাকৃত স্বল্প পুঁজির ব্যবসায়ীরা অর্থের কারণে অবকাঠামোগত কাজে পিঁছিয়ে থাকছে।
এ ব্যাপারে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) এর নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পরিবেশের বিষয় গুরুত্ব দিয়ে অনেক আগে থেকে এই ট্যানারি পল্লী সাভারে স্থানান্তরের বিষয় বলা হচ্ছে। এভাবে কয়েকটি বছর পেরিয়ে গেলেও তা কার্যকর হয়নি। এটা বড় ধরণের উদ্বেগের বিষয়। কেননা একবার যদি পরিবেশের কারণ দেখিয়ে চামড়া খাতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় তা হলে সেটি প্র্যাহার করতে বেশ কঠিন হবে। অনেক শর্তপূরণের বেড়াজালে পড়তে হবে। কারণ পরিবেশ দূষণের অজুহাতে ইতিমধ্যে বিশ্ববাজারের ক্রেতারা হাজারীবাগে উৎপাদিত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য কেনা বন্ধ করে দিয়েছে। এ অবস্থায় নিজেদের স্বার্থেই হাজারীবাগ থেকে দ্রুত ট্যানারি স্থানান্তর করতে হবে মালিকদের। উপযুক্ত পরিবেশে ও দ্রুত এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া না গেলে সরকার ও ট্যানারি মালিক উভয়কে লোকসানে পড়তে হবে। এজন্য মালিকদের গড়িমশি থাকলেও দেশের স্বার্থে সরকারকে নির্দেশনার পাশাপাশি তা বাস্তবায়নেও কঠোর উদ্যোগ নিতে হবে।
উল্লেখ্য, সাভারের বলিয়াপুর ইউনিয়নের হরিণ ধরায় নদী তীরে ১৯৯ দশমিক ৪০ একর জমিতে পরিবেশবান্ধব এ চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তুলছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। সেখানে বিএফএলএলএফইএ’র আওতাধীন ১৫৫টি শিল্প ইউনিটের অনুকূলে ২০৫টি প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ওই ১৫৫ ট্যানারি কারখানা স্থানান্তরিত হবে হাজারীবাগ থেকে।
জনস্বাস্থ্যের কারণে ২০০৩ সালে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্পনগরী অপেক্ষাকৃত কম জনবসতি এলাকা সাভারে স্থানান্তরের চিন্তা-ভাবনা করে সরকার। ওই বছরের ১৬ আগস্ট একনেকে প্রকল্পটির অনুমোদন দেওয়া হয়। অনুমোদনকালে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪৭৭ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০০৫ সালে। কিন্তু কাজ শেষ না হওয়ায় দফায় দফায় সময় ও ব্যয় বেড়েছে। বর্তমানে ১ হাজার ৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ডিসেম্বর মাসে। শিল্পনগরীর সাড়ে ১৭ একর জমিতে নির্মিত হচ্ছে সিইটিপি। সিইটিপি নির্মাণের কাজ করছে চীনের জেএলইপিসিএল-ডিসিএলজেভি লিমিডেট। চীনা প্রকৌশলীদের দ্বারা আগামী দুই বছর এ শিল্পনগরীর কাজ চলবে।
সম্পাদনা: মাহতাব শফি