
নিজস্ব প্রতিনিধি,
ঢাকাঃ বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলেও বিভিন্ন ধরনের চালের দাম কেজিতে সর্বোচ্চ চার টাকা করে বেড়েছে, সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সরু চালের দাম।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও অন্যান্য এলাকার বাজারগুলো সরেজমিনে ঘুড়ে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা মূল্য বৃদ্ধির জন্য বড় বড় মিলগুলোকে দায়ী করছেন। তবে মিল মালিকরা বলছেন, দীর্ঘদিন দরপতনের সমস্যায় থাকা চালের মূল্য বৃদ্ধির ফলে তা ধীরে ধীরে ‘স্থিতিশীল’ অবস্থার দিকেই আসছে।
বৃহস্পতিবার (২৩ জানূযারি) মিরপুর-১ নম্বর মার্কেটে জনতা রাইস এজেন্সির পরিচালক মহিউদ্দিন হারুন জানান, গত ১৫ দিনে মিনিকেট চালের দাম তিন দফায় বেড়েছে। এই সময়ের মধ্যে প্রতিটি ৫০ কেজির বস্তায় দাম বেড়েছে অন্তত ২০০ টাকা। এছাড়া অন্যান্য চালের দামও একশ টাকা থেকে দেড়শ টাকা করে বেড়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, মিনিকেট চাল এখন মওসুমের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। আগামী এপ্রিলের দিকে মিনিকেট চালের নতুন ধান আসবে।
তবে মাত্র দেড় মাস আগেই বাজারে এসেছে আমন ধান, যা থেকে বিভিন্ন ধরনের মোটা জাতের চাল হয়। ভরা মওসুমেও মোটা চালের দাম বৃদ্ধিকে মিলারদের কারসাজি হিসাবে দেখছেন ঢাকার পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা।
চালের মূল্য বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে নওগাঁ জেলা চালকল সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন বলেন, “গত দুই বছর ধরেই ধান ও চালের দাম অনেক কম ছিল। ফলে কৃষকরা লাভ তো দূরের কথা উৎপাদন ব্যয়ও সামাল দিতে পারেননি। দাম না পেয়ে ইতোমধ্যে অনেক কৃষক চাষাবাদ ছেড়ে দিয়েছেন। এটি বাজারের জন্য খুবই খারাপ খবর। দাম না বাড়ালে কৃষকদের চাষে ফেরানো যাবে না।”
চাল ব্যবসায়ী হারুন জানান, দাম বাড়ার পর রশিদ রাইস মিল থেকে এখন মিনিকেটের ৫০ কেজির বস্তা ২৩৫০ টাকা করে কিনতে হচ্ছে। প্রতি বস্তায় ৫০ টাকা খরচের পর বিক্রি করতে হচ্ছে ২৪০০ টাকার উপরে। মাঝখানে মিলে মিনিকেটের বস্তা দাম ২১৫০ টাকায় নেমেছিল। নতুন মওসুমের মোটা চালের দামও ৩০ থেকে ৪০ টাকা করে বেড়েছে।
নতুন মওসুমের আটাশ চালের দাম ৫০ কেজির বস্তা ১৫৫০ টাকা, গত বছরের পুরাতন আটাশ ১৭২০ টাকা। স্বর্ণা ও গুটির দাম ৫০ টাকা করে বেড়েছে। স্বর্ণা ১৪৫০ টাকা, গুটি ১৩৫০ টাকায় ৫০ কেজির বস্তা বিক্রি হচ্ছে।
পাইকারি বাজারে মিনিকেট চাল প্রতিকেজি ৪৮ টাকা থেকে ৫৯ টাকা হলেও খুচরায় তা বিক্রি হচ্ছে ৫৩ টাকা থেকে ৫৪ টাকায়।
বৃহস্পতিবার(২৩ জানূযারি) মীরপুরের পীরেরবাগ এলাকায় ছাপড়া মসজিদ মার্কেটে গিয়ে দেখা যায়, রশিদ রাইস মিলের মিনিকেটের ৫০ কেজির বস্তা বিক্রি করা হচ্ছে ২৪৫০ টাকা। আর ২৫ কেজির বস্তা বিক্রি করা হচ্ছে ১২৫০ টাকা।
কারওয়ানবাজারে মেঘনা রাইস এজেন্সির সারোয়ার হোসেন বলেন, গত এক সপ্তাহে চালের দাম ‘অনেক বেড়েছে’।
তার দাবি, মোটা চাল একশ টাকা থেকে দেড়শ টাকা বেড়েছে। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মিনিকেট চালের দাম সপ্তাহের ব্যবধানে ৩০০ টাকা বেড়েছে। আটাশ চাল ও নাজিরশাইলের দামও আড়াইশ টাকা করে বেড়েছে।
সরোয়ারের দোকানে ডায়মন্ড, মনজুর, সাগর, এরফান, রশিদ ও মোজাম্মেল ব্র্যান্ডের ৫০ কেজির বস্তা মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ২৪০০ টাকায়। সজিব ও নজরুল ব্র্যান্ডের ৫০ কেজির বস্তা মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ২৩৫০ টাকা।
আটাশ চাল রয়েছে ১৫৫০ টাকা থেকে ১৯০০ টাকার মধ্যে। রাজ্জাক ও পালকি ব্র্যান্ডের ৫০ কেজির বস্তা নাজির চাল ২৬০০ টাকা। মোটা চালের মধ্যে গুটি চালের ৫০ কেজির বস্তা ১৪০০ টাকা এবং পাইজাম চালের ৫০ কেজির বস্তা ১৫০০ টাকা।
চলতি আমন মওসুমে ২৬ টাকা কেজি দরে ছয় লাখ টন ধান সংগ্রহ করছে সরকার। সেই হিসাবে সরকারি সংগ্রহের আওতায় যাওয়া ধানের দাম পড়ে প্রতি মণ প্রায় ৯৮০ টাকা।
গত ২০ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া ধান সংগ্রহ অভিযান আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে। এর পাশাপাশি সরকার ৩৬ টাকা কেজি দরে তিন লাখ টন মোটা চাল সংগ্রহ করছে।
তবে এর মাঝেও বাজারে দীর্ঘদিন ধরে প্রতি মণ ৬৫০ টাকা থেকে ৭০০ টাকায় আমন ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে কৃষক।
এসব বিষয় উল্লেখ করে মিল মালিক ফরহাদ হোসেন বলেন, “গত দুই বছরে ভালো উৎপাদন হওয়ার সুযোগে ধান ও চালের দাম কমে গিয়েছিল, যা আরও বাড়ানো প্রয়োজন। আর ধানের দাম বাড়াতে হলে চালের দাম বাড়ানোর বিকল্প নেই।”
মোটা চালের সরকার নির্ধারিত দাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, “মোটা চালের দাম সরকার নির্ধারিত প্রতিকেজি ৩৬ টাকায় উন্নীত করতে হলেও ৫০ কেজির বস্তার দাম উঠা উচিত ১৮০০ টাকায়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে মোটা চালের ৫০ কেজির বস্তা বিক্রি হচ্ছে ১৩০০ টাকা থেকে ১৪০০ টাকায়। এর কারণ হচ্ছে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ অনেক বেড়ে যাওয়া।”
সারা বছর রোপা আমন ধানের মণ যেন ৮০০ টাকার মধ্যে এবং বোরো ধানের দাম যেন কমপক্ষে ৯৫০ টাকার মধ্যে ধরে রাখা যায়, বাজারে সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
“২০১৭ সালে হাওড়ে বন্যা হলো, এর পরপরই রোপা আমনে ব্লাস্টের আক্রমণ হল। ওই বছর দেশীয় চাহিদা পূরণে সরকার ১৫ লাখ টন চাল আমদানির পরিকল্পনা করেছিল। আমরা চেয়েছিলাম অন্তত ২৮ লাখ টন চাল আসুক। কিন্তু ওই বছর ভারত থেকে প্রায় ৭০ লাখ টন চাল ঢুকে গেছে। পাশাপাশি দেশেও ভালো উৎপাদন হয়েছে। ফলে বাজার আর চাঙ্গা করা সম্ভব হয়নি।”
দীর্ঘদিন দাম ‘কম থাকার’ কারণে নিজ জেলা নওগাঁয় অন্তত ২০ শতাংশ জমি ধানের আবাদ থেকে গম ও ভুট্টার আবাদে চলে গেছে দাবি করে তিনি বলেন, “এটা বাজারের জন্য খুবই অশনি সংকেত। কৃষক বার বার লোকসানে পড়ে ধান চাষে অনীহা দেখাচ্ছে। অনেকে স্থায়ীভাবে আম চাষে চলে যাচ্ছে। কিন্তু আম চালের মতো মৌলিক খাবার নয়।
“এই পরিস্থিতির উত্তরণের জন্যই বলেন, আর স্ট্যান্ডার্ডে যাওয়ার জন্যই বলেন, ধান-চালের দাম বাড়াতে হবে,” বলেন এই মিল মালিক।
এএমএন/