
ফারহানা করিম চৌধুরী:
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক নেতাদের যৌন কেলেংকারির খবর যখন গণমাধ্যমে ফাঁস হয়ে যায়, তখন মানুষ বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে পড়ে। প্রিয় নেতাদের পদস্খলনে ব্যথিত হন সমর্থকরা। আবার কোন কোন নেতাকে বিরোধী দলের তোপের মুখে পড়তে হয়। এমনকি এসব ঘটনার জন্য পদচ্যুতিসহ বিচারেরও মুখোমুখি হতে হয়েছে অনেককে। বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেয়া এমন কিছু রাজনৈতিক যৌন কেলেংকারির ঘটনা জেনে নেয়া যাক।
- মনিকাগেট
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে সাড়া জাগানো রাজনৈতিক কেলেংকারির ঘটনা ওয়াটারগেট নামে পরিচিত। এই কেলেংকারির জন্য রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু মনিকাগেট কেলেংকারির জন্য ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন অভিশংসনের মুখে পড়লেও ভাগ্যক্রমে প্রেসিডেন্ট পদ বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রেসিডেন্টদের একজন বিল ক্লিনটন বলেছিলেন, ওই নারীর(মনিকা) সঙ্গে আমার কোন যৌন সম্পর্ক নেই।’ তার এই বাক্যটিই বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যমের শিরোনামে পরিণত হয়েছিল। বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচারিত হচ্ছিল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউজের তরুণ ইন্টার্ন মনিকা লিউনস্কির সঙ্গে তার গোপন প্রেমের খবর অস্বীকার করেছেন।
কিন্তু ক্লিনটন যতই অস্বীকার করুন না কেন বিভিন্ন ঘটনাবলি থেকে প্রমাণিত হয়, মনিকার সঙ্গে তার অবৈধ সম্পর্ক ছিল। ফলে দ্বিতীয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিশংসনের মুখে পড়েন তিনি।
মূলত ১৯৯৮ সালে ইন্টারনেট গসিপ সাইটে ক্লিনটন-মনিকার প্রেম কাহিনী প্রকাশিত হয়। ২১ বছর বয়সি মনিকার সঙ্গে বিল ক্লিনটনের ১৮ মাসের প্রেম কাহিনী নিয়ে সরব হয়ে ওঠে বিরোধী রিপাবলিকান পার্টি। তারা বিষয়টি কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চায়। অবশেষে চাপের মুখে পড়ে ক্লিনটন বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পরার ঘটনা স্বীকার করতে বাধ্য হন। অবশ্য জীবনের এই টালমাটাল সময়ে স্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সমর্থন সবসময় পেয়েছেন বিল ক্লিনটন।
- মনরো রহস্য
প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির জন্মদিনে হলিউডের সাড়া জাগানো তারকা মেরিলিন মনরো, যখন তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ‘হ্যাপি বার্থডে, মিঃ প্রেসিডেন্ট’ বলে গান গাইতে থাকেন, তখন তাদের রোমান্স নিয়ে যে গুঞ্জন চলছিল তা চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। ১৯৬২ সালের ১৯ মে নিউইয়র্কের মেডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে তারকা সমৃদ্ধ কেনেডির জন্মদিনের উৎসবটি টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। অবশ্য তার আগে থেকেই কেনেডি-মনরোর প্রেম কাহিনী নিয়ে গুজব শাখা প্রশাখা মেলতে শুরু করেছিল।
তবে মনরো যে কেবল প্রেসিডেন্ট কেনেডির প্রেমেই মগ্ন ছিলেন তা নয়, বলা হয়ে থাকে একই সময়ে কেনেডির ভাই অ্যাটর্নি জেনারেল রবার্ট কেনেডির সঙ্গেও তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু হলিউড তারকার বন্ধুদের দাবি, মেরিলিন মনরোর মন জুড়ে ছিলেন প্রেসিডেন্ট জন কেনেডি। তিনি নিজেকে ভবিষ্যত ফার্স্টলেডি বা প্রেসিডেন্টের স্ত্রী হিসেবে কল্পনা করতেন।
কেনেডি আকস্মিকভাবে মনরোর সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙ্গে দেয়ার পর গ্ল্যামারাস এই তারকা ভেঙ্গে পড়েন। ১৯৬২ সালের আগস্টে মনরোর রহস্যাবৃত এবং দুঃখজনক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। যদিও সবাই জানেন, তিনি আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু তার মৃত্যুর কারণ নিয়ে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র তত্ত্বেরও উদ্ভব ঘটে। বলা হয়ে থাকে, কেনেডির সঙ্গে মনরোর সম্পর্কের কারণেই তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। তিনি কেনেডি পরিবার সম্পর্কে এমন কিছু জানতেন, যা সেই পরিবারের সুনামহানি ঘটানোর জন্য যথেষ্ট ছিল।
- নব্য রাশিয়ার প্রথম যৌন কেলেংকারি
একটি ভিডিও যা ধ্বংস করে দিয়েছিল একজনের ক্যারিয়ার। সেখানে একজন ব্যক্তিকে দু’জন পতিতার সঙ্গে দেখা গেছে। ১৯৯৯ সালের মার্চে রাশিয়ার রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত টিভি চ্যানেলে ভিডিওটি প্রচারিত হয়। দাবি করা হয়, ভিডিওর ব্যক্তিটির সঙ্গে তৎকালীন রাশিয়ার প্রসিকিউটর জেনারেল ইউরি স্কুরাতোভের চেহারার সাদৃশ্য রয়েছে। যৌন কেলেংকারির এই ঘটনাটি এমন এক সময়ে ফাঁস হয়, যে সময়ে রাশিয়ার জনগণ এধরনের ঘটনার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। সুদীর্ঘ সোভিয়েত শাসনামলে রাজনৈতিক নেতাদের যৌন কেলেংকারির ফাঁসের ঘটনার সঙ্গে অভ্যস্ত ছিলেন না তারা।
অবশ্য স্কুরাতোভের যৌন কেলেংকারি ফাঁসের আগে তিনি কতিপয় ডাকসাইটে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত শুরু করেছিলেন। স্কুরাতোভ অভিযোগ করেন, তার দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে ভীত হয়ে তাকে হেয় করার জন্য মিথ্যা ভিডিওটি তৈরি করা হয়। কিন্তু তৎকালীন রুশ প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলেতসিন স্কুরাতোভের সমালোচনা করেন। অবশ্য ভিডিওর ব্যক্তিটি যে প্রসিকিউটর জেনারেল স্কুরাতোভ ছিলেন, তা প্রমাণ করা যায়নি। এমনকি পরবর্তীকালে যেসব প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাতে ধারণা করা হচ্ছে এটি একটি সাজানো ভিডিও ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও স্কুরাতোভকে বরখাস্ত করা হয়।
- রাষ্ট্রপতির যৌন অপরাধ
এটি ইসরাইলের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ানক এবং নোংরা যৌন কেলেংকারির ঘটনা। তোলপাড় ফেলে দেয়া যৌন অপরাধের এই ঘটনায় দেশটির প্রেসিডেন্ট মোশে কাতসাভ ২০০৭ সালে পদত্যাগ করেন। এক বছর আগে প্রেসিডেন্ট কাতসাভ, অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে অভিযোগ করেছিলেন, তার একজন নারী কর্মচারী তাকে(প্রেসিডেন্ট) ব্ল্যাকমেইল করছে। কিন্তু তদন্তের পর ঘটনাটি প্রেসিডেন্টের বিপক্ষে চলে যায়। কারণ নারীটি প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনেন। এর পর থলের বেড়াল বেরিয়ে পড়তে থাকে। প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে একে একে দশজন নারী যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন।
যদিও কাতসাভ অভিযোগগুলি অস্বীকার করেন। তিনি দাবি করেন, তাকে ফাঁসানোর জন্য ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। কিন্তু অ্যাটর্নি জেনারেল প্রেসিডেন্টের দাবি প্রত্যাখান করেন।
কাতসাভের দশকব্যাপী দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এর আগে কোন কেলেংকারির ঘটনা আঁচড় কাটতে পারেনি। পরিশেষে দর কষাকষির পরে ৫ সন্তানের এই জনক পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এক্ষেত্রে ধর্ষণের অভিযোগ থেকে রেহাই পেতে যৌন হয়রানির অভিযোগ মেনে নেন তিনি। ইসরাইলের আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি ১৬ বছরের জেল। তবে কাতসাভকে স্থগিত দণ্ডাদেশ দেয়া হয়। এধরনের চুক্তির মাধ্যমে প্রেসিডেন্টকে ধর্ষণের শাস্তি থেকে রেহাই দেয়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি মানবাধিকার কর্মীরা এবং অভিযোগ দায়েরকারীরা।
- দীর্ঘদিন গোপন রাখা প্রেমকাহিনী
তার আসল পরিচয়টি দীর্ঘদিন ধরেই গোপনীয় অবস্থায় ছিল। কিন্তু পিতার মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন ধরে গোপন থাকা ভালবাসার এই সন্তানটি নিজের অনুভূতির কথা বইয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করেন। এখানে পিতা অর্থাৎ ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেরার কথা বলা হচ্ছে। তার গোপন প্রণয়ের সন্তান ছিলেন মাজারিন প্যাঁজো।
মিতেরা ১৯৮১ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। কিন্তু সুদীর্ঘ এই সময়ে তার গোপন প্রেম কাহিনী এবং সন্তানের কথা গোপন রাখতে পেরেছিলেন তিনি। মিতেরার রক্ষিতা অ্যান প্যাঁজোর গর্ভে জন্ম নেন মাজারিন।
অবশ্য ১৯৯৪ সালে মিতেরার দ্বিতীয় মেয়াদের শেষদিকে মাজারিনের বয়স যখন ২০ বছর, তখন প্রেসিডেন্টের অবৈধ সন্তানের খবর প্রকাশিত হয়। মিতেরা জানতেন, তার বিবাহ বহির্ভূত অবৈধ যৌন সম্পর্কের ঘটনাটি তার জন্য বিপদজনক হয়ে উঠতে পারে। সেজন্য তিনি এটি গোপন রেখেছিলেন। ফলে স্বীকৃত দুই সন্তানের এই জনক এক দশক ধরে ডাবল জীবন যাপন করেছেন। একটি এলিসি প্রাসাদে তার বৈধ স্ত্রীর সঙ্গে, অপরটি তার রক্ষিতা অ্যান প্যাঁজোর সঙ্গে।
পরবর্তীকালে মিতেরার অবৈধ সন্তানের খবর গোপন রাখার ঘটনাটি ফরাসি ওয়াটারগেট কেলেংকারির মর্যাদা পায়।
- বিমানবালার সঙ্গে প্রেসিডেন্টের প্রণয়কাহিনী
চেক প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট ভাক্লাভ ক্লসের সঙ্গে দেশটির সরকারি বিমান সংস্থার একজন বিমানবালার প্রণয় কাহিনী বেশ আলোড়ন ফেলেছিল। ২০০৮ সালের মার্চে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুতে বিমানবালার সঙ্গে তার প্রেম কাহিনীর কথা স্বীকার করেন ক্লস। তার পুনর্নিবাচিত হওয়ার পরের দিন সকালে ৬৬ বছর বয়সি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সোনালি চুলের এক বিমানবালার ছবি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
প্রেসিডেন্ট স্বীকার করেন, বিবাহিত হওয়ার পরেও তার অর্ধেক বয়সি নারীর সঙ্গে প্রেম করার বিষয়ে ব্যাখ্যা দেয়া, তার জন্য কঠিন একটি বিষয়। তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত চেক জনগণ কিন্তু স্ত্রীর প্রতি প্রেসিডেন্টের এই বিশ্বাসঘাতকতায় ক্ষুব্ধ হননি। বরং তারা বিষয়টিকে খুশি মনেই মেনে নিয়েছেন। দেশটির সবচেয়ে বড় সংবাদপত্রে বলা হয়, বেশিরভাগ মানুষই প্রেসিডেন্টের গোপন প্রেম মেনে নিবেন। কারণ উপপত্নী রাখা প্রকৃত পুরুষের কর্ম হিসেবেই তারা গ্রহণ করবেন।
সূত্র: আরটি, সম্পাদনা: তুহিন সাইফুল