
মনিরুল ইসলাম রানা: সংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এদেশের শিল্পীদের মনোভাব সব সময় নিজেদের নিজস্বতার পক্ষে, আগ্রাসন রুখতে বারবার সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সাথে শিল্পী-সংস্কৃতি কর্মীরা মিলে রাস্তায় নেমেছেন। নিজেদের গান, নিজেদের নাটক, নিজেদের সিনেমা সব মিলিয়ে নিজেদের একটা ইন্ডাস্ট্রি, একটা স্বতন্ত্র পরিচয়।
কিন্তু সাম্প্রতিক দীপ্ত টিভিতে প্রচারিত সিরিয়াল গুলোর মান ও নির্মাণশৈলী নিয়ে বিভিন্ন মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া চলছে। কেউ কেউ আবার বলছেন এমন হুবহু নির্মাণ চর্চা আমাদের এতদিনের আগ্রাসন বিরোধী আন্দোলন নষ্ট করছে। এছাড়া এমন ঘটনা লজ্জারও জন্মদিচ্ছে।
দীপ্ত টিভির সিরিয়াল দেখে কেউ কেউ আবার একে নতুন ভারতীয় বাংলা চ্যানেল বলেও আখ্যা দিচ্ছে! এ ব্যাপারে দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সাথে কথা বলেছে নিউজনেক্সটবিডির বিনোদন বিভাগের কর্মরত সাংবাদিকরা।
সে কথোপকথনের বাছাইকৃত বক্তব্য পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল:
গণমাধ্যমকর্মী তির্থক আহসান রুবেল বলেন, ‘আসলে আমাদের চ্যানেলগুলোর অধিকর্তাদের চরম আকারের কনফিডেন্সের অভাব। নিজের যোগ্যতার প্রতি নিজেরই বিশ্বাস নেই। ফলে ভিনদেশী ফ্লেভারকে আপন করার চেষ্টা। কলকাতাবাসী আমাদের নাটক দেখে বড় হয়েছে, সেখানে আমরা এখন তাদের পিছু ছুটছি। দর্শক কেন তাদেরটা দেখে? কারণ বিজ্ঞাপন সন্ত্রাস নেই। গল্প আছে।’
অন্যদিকে আমাদের এখানে তার বিপরীত। এর মূল কারণ বাজেট। আমাদের কর্তাবাবুরা কলকাতার নির্মাতাদের ২/৩ লাখ টাকা পর্ব প্রতি বাজেট আর কোটি টাকার ক্যামেরা দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের নির্মাতাদের ৬০ হাজার দিতেই ফেটে যায়! বলবেন দর্শক চায় তাই এসব বানাবো! তাহলে পাল্টা জিজ্ঞেস করতে হয় যে, তরুণদের একটা অংশ ইয়াবা চায়, তাহলে কি প্রকাশ্যে আনবেন ইয়াবাকে! দীপ্ত টিভি বাংলাদেশের নাটকের এত বছরের ঐতিহ্য এবং আমাদের নির্মাতাদের অপমান করেছে বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘আরেকটা লজ্জার ব্যপার হলো, এই দেশের নামী-গুণী অভিনেতা অভিনেত্রীরা নির্লজ্জের মতো এসব অখাদ্য-কুখাদ্যে নিজেদের সপে দিয়েছেন। অবশ্য এসবের জন্য আমরা দর্শক, সাস্কৃতিক কর্মী, বিজ্ঞাপনী সংস্থা এবং মূল্যবোধহীন চ্যানেলকর্তারাই সবচেয়ে বেশি দায়ী।
নির্মাতা আবদুল্লা মাহফুজ অভি বলেন, ‘মার্কেট আমরা তৈরি করবো না নকল করবো তা ভাবার বিষয়। ব্যবসায়িক পরিকল্পনা মানে এই না যে নিজস্বতা এবং শিকড় অস্বিকার করতে হবে। আপনার সব দেখলে মনে হবে এরা জি বাংলার সাব চ্যানেল, নায়িকার শারি থেকে ঘরের সাজস্বজ্জা কিংবা সাউন্ড লোগাটা পাল্টে দিলেই মনে হবে আমরা জি বাংলা বা স্টার জলসা দেখছি। আমাদের নিজ্বসতা নিয়ে অন্যরা তো ব্যবসা করছে কিন্তু এভাবে হুবহু নকল করে আমাদের নিজস্বতাকে পেছন থেকে ছুরি মারার মত বিষয়। দীপ্ত টিভির এমন চর্চা থেকে ফিরে আসা উচিত।’
কথা হয়েছিলো রামপুরার গৃহিণী রত্নার সাথে দেশের টিভিতে কি দেখেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি বাংলা নাটক দেখি, ভালো লাগে। বস্তাপচা ওই ভারতীয় সিরিয়ালের থেকে তো বাঁচতে পারি।’
বস্তাপচা কেন বলছেন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘দেখেন ওরা যে অমানবিক দোটানার গল্প দেখায় তা ওপার বাংলা বা এপার বাংলার মধ্যবিত্তের মধ্যে নেই। তাদের বাসায় শিশু, মা এবং শাশুড়ি সবাই ভিলেন!’
বাংলা নাটকের মান নিয়ে প্রশ্ন করতেই তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত টক শো আর সংবাদের ভিরে ওই টুকুই তো আমাদের বিনোদনের জায়গা।’
দীপ্ত টিভিও হুবহু স্টার জলাসা ও স্টার প্লাস চ্যালেনের মতো বস্তাপচা গল্প দিয়ে সিরিয়াল নামের গো খাদ্য দেখাচ্ছে, সেখানে আমরা বা আমাদের স্বক্রিয়তা কোথায়? প্রশ্ন করেন সংস্কৃতি কর্মী সানাউল কবির। স্বক্রিয়তা বলতে আপনি কি বুঝাচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দেখেন আমি আমার স্বত্বা, এটাই আমি। দীপ্ত চোখ মোছা মেয়েটি এ বাংলার না এবং নির্মাণের এই ধরণ যদি এ্যাডাপ্ট করতে হয় তবে এতদিন ধরে আমার বাংলা, আমার বাংলা করে চিৎকার চেঁচামেচির মানে কি থাকলো?
সংস্কৃতি কর্মী ইসমাত আরা পুস্পা বলেন, ‘পরসংস্কৃতি কে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার মানে হল অনেকটা পরগাছার মত বেঁচে থাকা। যেখানে নিজস্ব একটা ইউনিক ভাষা আছে। সেখানে আমাকে কেন অন্যের সংস্কৃতির হুবহু অনুকরণ করে বাজারে কাটতি বাড়াতে হবে? অনেক সম্মানীয় ব্যক্তিবর্গ আছেন যারা নিয়মত আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে বিশ্বে তুলে ধরার জন্য লড়াই করে চলেছেন। তার মাঝেই এক দল দেখা যায় শর্টকাট অবলম্বন করে কমার্শিয়াল ফায়দা লুট করার জন্য বিবেকহীন হয়ে যাচ্ছে! অবশ্যই এটা একটা স্বার্থপরতা। এভাবে করে সামাজিক অবক্ষয়ের স্লো পয়জনিং হচ্ছে। সবাইকে টেলিভিশন মুখি করার এই প্রয়াস আমার মতে খুব বাজে প্রয়াস।’
সাংবাদিক জিয়াউল হাসান বলেন, ‘নির্মাণের এই ধরনটা আমাদের নিজস্ব না। হুবহু মিলে যায় ভারতীয় বাংলা চ্যানেলের সাথে। আমরা ওপারের ছায়া এড়াতে চাই যেনো নিজেদের ইন্ডাস্ট্রি টিকে থাকে। তবে এখন যদি সবাই এই দিকে ঝুঁকে পড়ে তাহলে ৯০ দশকের শুরুতে যে টেলিভিশন নাটকের ধারা শুরু হয়েছিলো তার মরণ হবে।
এ বিষয়ে দীপ্ত টিভি’র প্রোগ্রাম বিভাগের কমল সরকার বলেন, ‘গল্প সিলেকশনের করণে নির্মাণ শৈলী এমন।’ তবে এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি তিনি। কমল সরকার বলেন, ‘এর বেশি আমি বললে তা সুস্পষ্ট হবে না। তাই উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।’
নিউজনেক্সটবিডি ডটকম/এমআইআর/ওয়াইএ/এসজি