
কাজী ফৌজিয়া;
প্রিয় বন্ধু,
কেমন আছো তুমি কেমন আছে আমার দেশ? কত দিন তোমাকে লিখি না! কত কি যে লেখার ছিল। ভেবেছিলাম একবছরে দুবার বাংলাদেশ ভ্রমণের স্মৃতিগুলো লিখে জানাবো। কিন্তু মানুষ বাহে এক, আর হয় অন্য, আমার ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। বিশ্ব আজ যে অসহায়ত্বের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তাতে আমি থাকবো কিনা, তুমি থাকবে কিনা তারতো কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই ভাবলাম, যতক্ষণ বেঁচে আছি ততক্ষন লিখে যাই, আমার অভিজ্ঞতার কথা, আমার আশেপাশে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা ।
বন্ধু, বলছিলাম কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাস এর কথা। মরণঘাতী এই ভাইরাস নিয়ে তোমার দেশের মানুষ যে পরিহাস বা প্রহসন করতে পারছে, আমরা তা পারছি না।
গত ১৮ জানুয়ারী হংকং হয়ে যখন নিউ ইয়র্ক এ আসি তখন চায়নার উহানে রোগটি ব্যাপকতা ছড়িয়ে পরায় এবং আশ -পাশের দেশগুলোতে দু’চারজন রোগী পাওয়ার কারনে আমাদের ঢাকা থেকে জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ৩৩ ঘন্টা আমাদের মাস্ক পরে থাকতে হয়েছে ।
সেই ৩৩ ঘন্টা মনে হচ্ছিল শ্বাসরুদ্ধকর, কোনদিন শেষ হবে না; জেএফকে তে নেমে মনে হচ্ছিল বেঁচে গেছি। সেই দিন ঘুনাক্ষরেও ভাবিনি আমাদের প্রিয় শহর নিউ ইয়র্কও হয়ে যাবে উহানের মতো। এখন ইতালীতে বন্ধু আইরিন-এর পরিবার, যুক্তরাজ্যে আমার বোন লিলির পরিবার আর নিউ ইয়র্কে আমি – আমরা আর কেউ কারো জন্য উদ্বিগ্ন হতে পারিনা, কারন আমরা জানি, আমরা সবাই এখন মৃত্যুকুপে বসবাস করছি। রাতারাতি বিশ্ব দৃশ্যপট বদলে গেলো।

যদি নিয়তির জোরে, দৈবক্রমে এ যাত্রা বেঁচে যাই, ভাল। নইলে আমাদের কেউ কাউকে আর কোনদিন দেখতে পাব না। বন্ধু তোমরা বাংলাদেশে হয়ত এর চেয়ে বেশী খারাপ আছ। শুধু সঠিক নাম্বারটা অজানা। লোকজন বলে চীনে মৃতের সংখা নিয়ে সংবাদ মাধ্যমকে ধোকা দেয়া হয়েছে , কিন্তু রোগের ভয়াবহতা নিয়ে কোন রকম কারচুপি করা হয়নি। চায়না নিজের দেশ কে বা জনগনকে বাঁচাতে যা করনীয় তা করেছে কঠিন হস্তে, নিজের জনগনকে দমন করে ভইরাসটি কে পরাস্ত করেছে। চায়না যখন নতুন করোনা নামক ভয়ংকর শক্তিশালী জীবানুটির বিরুদ্ধে একা লড়াই করছিল বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থা ও অন্যান্য দেশগুলো হয়ত ভেবেছিল এটা তাদের অভ্যন্তরীন বিষয়।সোশ্যাল মিডিয়াতে কত পোস্ট সমালোচনা – সাপ বা বাদুর খাওয়ার দোষ! !
কোন কোন দেশে তো চায়নার মানুষদের সাথে রেসিজমের মাত্রা বাড়িয়ে দিলো – যা গায়ে হাত তোলাতেও পৌছে গেছে! আমাদের কাঠ মোল্লারা চীনে মুসলমানদের সাথে যে অন্যায় করা হয়েছে তার প্রতিশোধ হিসাবে সৃষ্টি কর্তার গজব আখ্যা দিল রোগটির প্রকৃতি আর বিস্তার লাভের মাধ্যম ও রোগটির ভয়াবহতা সম্পর্কে না জানার কারনে। খুব বেশি দেরি লাগল না বাদ বাকি দুনিয়া তে এর ধাক্কা লাগতে।
যখন আমি বিমানবন্দরে নামলাম, জেএফকে তে ও দেখেছি শুধু চায়না থেকে আগতদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিলো। “তোমার কি সর্দি কাশি ও জ্বর আছে কি না।” ব্যাস! তারা খবর রাখল না যে তার নিজের লোকই বহন করে নিয়ে এসেছেন ভয়ঙ্কর এই ভাইরাস! ঐ যে বললাম সর্দি কাশি জ্বর এই ছিল করোনার লক্ষন! রোগের অজ্ঞতার কারণে জানতেও পারল না ১৪ দিন এই রোগ দেহে বহন করে আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ লোকের মত ঘুরে বেরিয়ে ১৪ শ লোককে আক্রান্ত করতে পারে। কোরিয়া, জার্মান, ইটালি, ইরান, ইউ কে এই ভাবে আক্রান্ত ব্যক্তিরা দুনিয়া জুড়ে ছুটাছুটি করে যখন অর্ধেক এর বেশী দুনিয়া এক মাস সময়ে আক্রান্ত হয়ে যায়।

আমাদের আমেরিকায় শুরু হয় জানুয়ারী ১৯। ওয়াশিংটন স্টেট থেকে একজন রোগী শনাক্ত হওয়ার পর আজ ২১এ মার্চ প্রজন্ত ২ মাসের ব্যবধানে আমেরিকার ৫০ টি স্টেট ও কলোনিগুলো আক্রান্ত। গতকালের হিসাবে দেখা যায় আমেরিকায় মোট ১৯,৪৫৯ জন আক্রান্ত, মারা গেছেন , ২৬ জন সেরে উঠেছেন । এই ১৯,৪৫৯ আক্রান্তদের মধ্যে নিউ ইয়র্কের রুগী সংখা হল ৮,৫১৬ জন। মারা গিয়েছেন ৫৩ জন। আগামি এক সপ্তাহে এই সংখ্যা উপরে উঠবে, কারন হাজার রুগী ঘরে অপেক্ষা করছে টেস্ট করানোর জন্য! পর্যাপ্ত টেস্ট কিটের অভাবে করোনা পরিক্ষা করাতে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়। আমাদের মেয়র আর গভর্নর প্রতিদিন ট্রাম্প এর কাছে সাহয্যের জন্য আপিল করে, আর সে প্রতিদিন করোনা ভাইরাস কে “চাইনিজ ভাইরাস” বা “ফরেন ভাইরাস” বলে জোকার এর মত কথা বলেই চলছেন।
বন্ধু, ইতালির কথায় আসি -গত জানুয়ারি ২০ রোম এ দুইজন চায়নিজ টুরিস্ট এর করোনা পজেটিভ ধরা পরেন, সেই থেকে এই এক মাস ২০ দিনে মোট আক্রান্ত ৪৭,০২০ জন. মোট মারা গেছেন ৪,০৩২ জন, সেরে উঠেছে ৫,১২৯ জন। যে চায়নাতে রোগটির বিস্তার শুরু হয়েছিল মোট আক্রান্ত ৮১,০০৮ জন মারা গিয়েছেন ৩,২৫৫ জন এবং সেরে উঠেছেন ৭১,৭৪০ জন। আমি গবেষক নই বেশী নাম্বারে যাব না শুধু বলব বিশ্বের জনসংখ্যার মোট ২৮৭,৩৭৯ জন আক্রান্ত, মারা গিয়েছেন ১১,৯৫১ জন, সেরে উঠেছে ৯,২৫৯২ জন। এতগুলো নাম্বার এই জন্য দিলাম এই কারণে এই যে রোগটি চায়নার বাইরে এত বিস্তার লাভ করেছে তা শুধু আমাদের স্বার্থপর চিন্তা – ওহ রোগটি চায়নার সমস্যা- অবহেলা – ওহ আমার হবে না আমার খাদ্যাভাস চায়নার মত না ইত্যাদি ধারণার কারণে – অজ্ঞতা – শুধু শর্দি কাশি জ্বর হলো করোনা শনাক্তের উপসর্গ !

কেন আমরা জানতে পারিনি আক্রান্ত দেশ থাকে আসা যে কোন ব্যক্তি সম্ভাব্য রুগী হতে পারে তাকে নির্জনে রাখ হোক। আক্রান্ত ব্যক্তি সাধারণের মাঝে মিশে গেলে কি ভয়াবহ বিপদ হতে পারে এখন কেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মাইক নিয়ে বলছে?কেন মহামারি বলতে এত দেরি করল? সবই এখন প্রশ্ন, প্রশ্ন আর প্রশ্ন।
বন্ধু, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আর বৈশ্বিক নেতারা অনেক দেরি করে ফেলেছেন ।
বিশ্ব নেতাদের কারো কারো মধ্যে এখনো করোনা নিয়ে রং তামাশা, বাণিজ্যিকীকরণ, অবহেলা, স্বার্থপরতা, মিথ্যা চলছে। ইরানে মোট রুগীর সংখ্যা ২০,৬১০ জন মারা গিয়েছেন ৭,৬৩৫ জন, সেরে উঠেছেন ৭,৬৩৫ জন,হিসাবে দেখা যায় পুরো বিশ্বে মৃত্যু হার শতকরা ২ ভাগ আর ইরানে মৃত্যুর হার ৩.৫ ভাগ ! কারন ইরান একাই লড়ে যাচ্ছে, চিকিৎসা সামগ্রীর প্রচন্ড অভাব দেখা দিয়েছে তবু অন্য দেশ থেকে আনতে পারছে না, কারন ঐ নিষেধাজ্ঞার কারনে! এই মহামারির সময়ে কেউ ইরানের কথা ভাবছে না ! কি স্বার্থপর সময়ে আমাদের বসবাস!
তোমার-আমার দেশ বাংলাদেশ তো এই বিষয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেছে! এই মহামারির সময়ে যখন গোটা বিশ্ব হিমসিম খাচ্ছে, তার নিজের দেশের জনগন ভিবিন্ন রাষ্ট্রে মারা যাচ্ছে, ভয়ে কাঁপছে; তখন কোটি টাকার আতশবাজী,কেক কাটা সরবপরি উপ নির্বাচন দেওয়া! কি বলব ভেবে পাই না ।এই রোগ মানুষের শরীর কে উপজীব্য করে ছড়িয়ে গেছে সারা দুনিয়ার ঘরে ঘরে; তাই সারা দুনিয়া তাদের জনগন কে হাতে পায়ে ধরে, আইন প্রয়োগ করে, লাঠি ডান্ডার ভয় দেখিয়ে ঘরে রাখতে হিমসিম খাচ্ছে।
আর আমার দেশের মন্ত্রী-স্বান্ত্রী আর পীর হুজুররা তাদের জনগনকে হ্যামিলনের বংশী বাজিয়ে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে।জোকারের দল, মানুষকে ঘরে থাকার উপদেশ দিয়ে নিজেরাই এক-পাল লোক নিয়ে কর্মসূচি করে বেরাচ্ছে !বাংলাদেশ এর রাজনিতিবীদ আর জনগন আগুন নিয়ে খেলছেন। তারা জানেন ও না তারা কি ভয়াবহ বিপদের মধ্যে আছে।আমি ঘুম থেকে উঠে যত জন প্রবাসীর কল পাই সবার শুধু একটাই কথা আপা, আমাদের যা হবে দেখা যাবে কিন্তু দেশের মানুষের কি হবে? আমাদের দেশ পারবে তো মোকাবিলা করতে? অতপর: আমরা বলি হে আমার দেশ তুমি আমার প্রার্থনায় আছ; ঈশ্বর তুমি বাংলাদেশ কে রক্ষা কর!

বন্ধু, অনেক হতাশার কথা বললাম। এবার শুনো তোমার সদা চঞ্চল বন্ধুর সেচ্ছানির্বাসনের দিনগুলির গল্প। সেচ্ছায় গৃহবন্ধি জীবনের আজ ১১দিন। মার্চের ১১ তারিখে অফিস থেকে যখন বলল আমাদের ঘরে থেকেই অফিস করতে হবে, বাইরে যাওয়া মানা। শুধু খাবার বা দিনে একবার নির্জনে হাঁটার জন্য বাইরে যেতে পারব! আমি চেষ্টা করলাম বলতে একটু পরে সিদ্ধান্ত নাও এখনো তো পরিস্থিতি এত খারাপ হয়নি,সবাই বলল কবে যখন আমরা অন্যকে সংক্রমিত করব তখন? আমি চুপ রইলাম। আর মনে মনে ভাবলাম হায় আল্লাহ ঘরে কি করে বন্দি থাকব! একাকী জীবনে মানুষ ই তো আমার বেচে থাকার অবলম্বন, মানুষের সাথে দেখা হবে না, বাইরের আলো বাতাস গ্রহন করতে পারব না। এ কেমন সাজা!
বন্ধু, তুমি তো জানো আমি কেমন লড়াকু, অধিকার আদায়ের জন্যে প্রশাসনের সাথে যেমন লড়াই করি আজ লড়াইটা নিজের সাথেই। বৃহস্পতিবারের ঘুম থেকে উঠেই বন্দি জীবনের সিডিউল বানিয়ে ফেললাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা + ইটালি, ইউকে বাংলাদেশে থাকা আত্মীয়-বন্ধুদের খোঁজ খবর নেওয়া। সকাল ১১ টা র মধ্যে ল্যাপটপ মোবাইল নিয়ে কাজে বসে যাওয়া,মেম্বারদের খোঁজ নেওয়া, তাদের মেন্টাল সাপোর্ট,করোনা সেইফটি এডুকেশন,কোন ইনফরমেশন লাগলে তা প্রদান করা। সেন্সাস এডুকেশন ও ফর্ম পূরণ করতে সহযোগিতা করা,স্টাফ চেকিং, কে কেমন আছে কাজ কিভাবে করবএইসব।কনফারেন্স কল থাকলে তাতে যোগ দেওয়া,তদুপরি সামাজিক যোগাযোগ রক্ষা করা।সমাজের কারো সাহায্য লাগবে কি না জানতে চাওয়া ও সারাদিন নিউজ আপডেট দেখা। রাত ১২ টা বেজে গেলে ঘুমিয়ে যাওয়া।গত ১১ দিন এই ভাবে চলছে! টিভি দেখিনি! অকারন বাজার করিনি! দুই আইটেমের বেশী রান্না করিনি! বাইরে হাঁটতেই যাইনি!
ঘরে বসে খুব ভাল যেটা করতাম সেই বই পড়ারও সময় পাইনি।শুধু একদিন ড্রাম মেম্বারকে সাপোর্ট করতে কোর্টে গিয়েছিলাম। তবুও সময় ভাল কেটে যাচ্ছে সেটা বোধহয় আমার মানুষের প্রতি অগাধ ভালবাসার কারনে! করোনা ভাইরাস আমাদের শারীরিক যোগাযোগ শেষ করে দিয়েছে, কিন্তু ভার্চুয়াল সামাজিক যোগাযোগ বাড়িয়ে দিয়েছে। আমার এমনও মেম্বার আছেন যারা গত ২ বছরে হ্যালোও বলে নাই, কিন্তু এখন নিয়মিত কথা হয়, আমরা ভিডিও কলে কথা বলি, সকলে সকলের খোঁজ রাখি।

আমরা এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও সেন্সাসের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কাজ করতে প্রতিশ্রুতি পাই। এটাইবা কম কি! আমরা ঘরে বসেও বাড়ী ভাড়া বন্ধের জন্য পিটিশন করি,কর্মহীন মানুষের খাদ্যাভাব দুর করতে মিচুয়াল এইড নিয়ে কথা বলছি।
মোট কথা, সব মানুষই অংগিকার করছে আরেকজন মানুষের পাশে থাকার।মানুষের মানসিক শক্তি টা এখনো ভাল আছে; একে অপরের পাশে থাকার অংগীকার করার মনোবল আছে, মহামারির এই খারাপ সময়ে একে অপরের মনোবল ধরে রাখার চেষ্টা। এটাই হোক আমাদের প্রয়াস। মৃত্যুপুরিতে দাড়িয়ে জীবনের গল্প বলছি এই বা কম কি! আমি বাইরে গিয়ে নিজ বা অন্য কারো মৃত্যুর কারন হব না এটাতো ফাইনাল! তারপরেও যদি মারা যাই শান্তিতে মারা যাব এই ভেবে যে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমি মানুষের কল্যাণ চিন্তা করেই বেঁচেছি!
দোয়া করি ভাল থাক বন্ধু., ভাল থাকুক আমার দেশ ও দেশের মানুষ
ইতি তোমার বন্ধু
যাকে তুমি কোন নামেই ডাকো না
