
প্রিয় বন্ধু,
কেমন আছো তুমি? আমি সবসময় আশা করি ভাল থাক। বন্ধু, তোমার কপাল বা ভাগ্য অনেক ভাল নইলে অবলীলায় যাদের অবজ্ঞা বা অবহেলা কর তারা তোমায় ভালবাসবে কেন? যদিও তোমার নিজের একটা দর্শন আছে — এই বিষয়ে কী যেন বল — পারসেপ্সন মানে উপলব্ধি মানে তুমি আমাদের ভাল জান —কিন্তু আমরা তা উপলব্ধি করতে পারি না। আহা, বুঝলে বন্ধু, আমরা হলাম গণ্ডার, উপলব্ধিহীন বা কম উপলব্ধি সম্পন্ন মানুষ। তাই তোমার খারাপ ব্যবহার বা অবহেলা অথবা এড়িয়ে যাওয়া আচরণ থেকে ভালোবাসা বা পছন্দ খুঁজে পাই না। এখন সক্রেটিস – এর ভক্ত হয়ে উঠতে পারিনি যে বিষ এর পিছনে অমৃত দেখব। এখন থেকে ভাবছি তোমার অনুগ্রহ, দয়া, ভালোবাসা এই তিনটির একটিরও আমার প্রয়োজন নেই। ভাল দাম পেলে হাটে গিয়ে বিক্রি কর এসব। আমি আমার কাজ আর আমার জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করি। তোমার জীবন তোমার দর্শন তোমার কাজ তোমার সুখ তোমার পারসেপ্সন এর গ্যাঁড়াকলে ফেলে উপভোগ কর।
বন্ধু, তোমার ওপর রাগ করা সময়ের অপচয় আর মানসিক শক্তি ক্ষয় ছাড়া কিছু নয়। যে আমাকে দুই আনার দাম দেয় না তার সাথে কিসের রাগ। চল কাজের কথা বলি। এটা তুমি ভাল বোঝ। নিউ ইয়র্কের বা আমেরিকার কথা আজকাল বলে শেষ করা যায় না।
বন্ধু, ট্রাম্প এর কথা বলতে বলতে একঘেঁয়ে হয়ে যাচ্ছে চিঠি। তাই আজ অন্য বিষয় নিয়েও কথা বলব। তোমাকে চিঠি লেখার পর তেমন বড় কোন হাঙ্গামা করেনি। দু’একটি নির্বাহী আদেশ দিয়েছে — যার একটি হল ১০ হাজার ইমিগ্রেশন পুলিশ নিয়োগ দেবে কাগজপত্র-বিহীন নাগরিকদের বহিষ্কারের জন্য। বিশেষ করে যাদের নামে কোন ধরণের অপরাধ লিপিবদ্ধ আছে। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পরে ৭৮৪ জন মানুষকে ইমিগ্রেশন পুলিশ আটক করেছে। নিউ ইয়র্ক থেকে আটক হয়েছে ৪১ জন। আমার জানা মতে ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশের আওতায় কোনো বাঙালি বা সাউথ এশিয়ান আটক হয়নি, যদি কেউ আটক হয়ে থাকে তা ইমিগ্রেশনের সাধারণ কাজকর্ম যা তারা সবসময় করে থাকে। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ওবামা প্রায় ৩ লক্ষ মানুষ বহিষ্কার করেছিল যা আমেরিকার সর্বকালের ইতিহাসকে ছাড়িয়ে গেছিলো।
আমি এই তথ্যের মাধ্যমে ট্রাম্প এর বৈরি অভিবাসী নীতিকে হালকা করে দেখছি না। নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা বলেন আমেরিকার ইতিহাসে এমন জঘন্য প্রেসিডেন্ট আসেনি, যে একসাথে এত ভিন্ন ধর্মের, ভিন্ন বর্ণের বা ভিন্ন জাতীয়তাকে আঘাত করেছিলো। তার বক্তব্য আর তার মন্ত্রী পরিষদের ইতিহাস দেখে চারিদিকে এত আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে গুজব আর সত্যির ব্যবধান বোঝা মুস্কিল। এই লোক কথায় কথায় সংবাদ মাধ্যমকে হুমকি আর জনগণকে আতংকিত করা ছাড়া আর যেন কোন কাজই জানে না। এই আতংকে আমার জীবন চিরে চেপ্টা হয়ে গেছে।
বন্ধু, ভাবছ কিভাবে? বলছি শোন।
রোজ গুজব শুনা যায়, এত মানুষ ইমিগ্রেশনে আটক হয়েছে, অমুক জায়গায় ইমিগ্রেশন রেইড হচ্ছে, অমুক জায়গায় বাস থেকে নামিয়ে চেক হচ্ছে আর কাগজপত্র নাই মানুষকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। বাসে রেইড, ট্রেনে রেইড, রাস্তায় রেইড — সব জায়গায় রেইড আতঙ্ক। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে, আমি বলব ৮৫ ভাগ ক্ষেত্রেই এসব খবর গুজব। অন্য রাজ্যে হয়ত অনেক বেশী সত্যি কিন্তু নিউ ইয়র্কে এখনো অবস্থা এত খারাপ নয়।
এইসব গুজবের কারণে মানুষ ট্রেনে উঠতে চায় না, কেউ কেউ বাচ্চাকে স্কুলে পাঠাতে চায় না। কেউ কাজ ছেড়ে ঘরে বসে আছে। মাঝে মাঝে নিজেকে অসহায় লাগে। কী করে মানুষের ভয় কাটিয়ে ভয়কে শক্তিতে পরিণত করব সেটাই বুঝি না। সমাজ অথবা মেম্বারদের কাছ থেকে প্রতিদিন যত ফোন কল পাই তার বেশির ভাগ গুজব নিয়ে উৎকণ্ঠিত কল। একটু যদি বিরক্ত কণ্ঠস্বরে প্রকাশ পায় সবাই বলে আপা রাগ করবেন না, আপনার সাথে কথা বলে সাহস পাই। আমি তাদের বলি, আমি রাগ করি নাই। কিন্তু একই বিষয়ে কথা বলে বলে আমি ক্লান্ত, তবু আমি বলব, আবার কল করবেন। আমি যত ক্লান্ত হই তাতে কিছু আসে যায় না। আমি চাই না আপনারা সাহস হারান।
এই গুজব অন্য রাজ্যের জন্য সত্যিকারের ভয়। অন্য অনেক রাজ্যে লোকজনকে রাস্তা থেকে উঠিয়ে নিচ্ছে। হেইট ক্রাইম বা ঘৃণার কারণে হামলা বেড়েই চলছে, মসজিদে আগুন বা ইহুদীদের সেমেট্রিতে হামলা ছাড়াও গত সপ্তাহে ক্যানসাসে এক ভারতীয়কে মেরে ফেলা হয়েছে। খুনের পূর্বে ঐ ব্যক্তিকে বলা হয়, ‘কেন এই দেশ ছেড়ে সব চলে যাচ্ছিস না’। সাদা সন্ত্রাসীরা আমাদের জাতীয়তা বা ধর্ম বুঝে না তারা দেখে আমাদের চামড়া। বহু ইন্ডিয়ান নাগরিক ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছে। ট্রাম্প এর জন্য ফান্ড জোগাড় করেছে। ইন্ডিয়াতে ট্রাম্প এর পুঁজা হয়েছে কারণ, ট্রাম্প মুসলিমদের ঘৃণা করে। আজ যেমন করে ইহুদি বা জুইস সমাজ অভিবাসী ও মুসলিমদের পাশে দাঁড়িয়েছে ঠিক তেমন করে ইন্ডিয়ানদেরও বুঝতে হবে ট্রাম্প মুসলিম বিদ্বেষী হলেও তাদের বন্ধু নয়। ট্রাম্প মনে করে সিলিকন ভ্যালিতে অনেক বেশি ইন্ডিয়ান কাজ করছে যাদের এইচ ওয়ান ভিসা কন্ট্রোলের বা নির্বাহী আদেশ জারী করে বিদায় করতে হবে। সকল দেশ ও সমাজের মানুষ বুঝতে হবে ট্রাম্প সাদা ছাড়া আর কারও বন্ধু নয়। আমরা ৮ মার্চ ইন্টারন্যাশনাল ওমেন্স ডে তে ‘ডে উইথ আউট ওমেন্স স্ট্রাইক’ এ যাচ্ছি। মহিলারা আবারো নিজেদের ক্ষমতা ট্রাম্পকে দেখাতে চায়। আশা করি সর্বস্তরে সাড়া পাওয়া যাবে।
বন্ধু, ট্রাম্পকে নিয়ে কথা কম বলব বলেও কত বলে ফেললাম। ট্রাম্প এমন এক আপদের নাম এটার নাম নিব না বলার পরও হাজার বার বলা হয়ে যায়। চল অন্য কথায় যাই, গত সপ্তাহে নিউ ইয়র্কে হয়ে গেল ২১ ফেব্রুয়ারি। অন্য বছরের মত বাংলাদেশ সোসাইটি সহ অন্যান্য সমিতিগুলো মহা ধুমধামে দিনটি পালন করল। দিনটি ছিল সাপ্তাহিক বন্ধের দিন। আমি বাসায় ছিলাম। অনেক মানুষ ফেইসবুকে লাইভ দিতেছিল। আমি দেখে ভাবলাম আমি কেন আজ কাল পাড়ের সাদা শাড়ি পরে হাতে ফুল নিয়ে ঐ কোলাহলে নেই? আমার বাঙালিত্ব কি কমে গেছে? জাতীয়তাবোধ কি নেই আমার?
গত দুই বছর ধরে জাতিসংঘের সামনে পালিত হচ্ছে ২১শে ফেব্রুয়ারি। কেউ আমাকে ডাকেও না, আমিও যাই না। গত বছর বাংলাদেশ সোসাইটি আমাদের সম্মাননা দিয়েছিল, তাই গিয়েছিলাম। না গেলে তাদের অসম্মান করা হবে বলে যাওয়া। আমাকে এইবার একজন জিজ্ঞাসা করল কেন আমি যাই না। আমি হেসে বললাম, কেউ আমায় ডাকে না। সে বলল, ডাকতে হবে কেন? একজন গর্বিত বাঙালি হিসাবে আপনার দায়িত্ব এখানে আসা। আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম, হয়তোবা আমি একজন গর্বিত বাঙালি না, সমাজের এত বিভাজন, আলাদা আলাদা আয়োজন, একদিনের বাঙালি সাজার মাঝে গর্ব খুঁজে পাই না! এইসব আয়োজনের জন্য কত লোক রয়েছে। কিন্তু আমি যে কাজ করি অধিকার আদায়ের, সে সংগ্রামে আমি বা মুষ্টিমেয় আমরা খুব কম। আমাদের পথ বড় কাঁটা পূর্ণ আর জটিল। সেই পথ পাড়ি দিতে দিতে গলা ফাটিয়ে শ্লোগান দিতে দিতে গলায় আর গান আসে না। নরম শরম মহিলা সেজে শাড়ি পরে বৈশাখ আর একুশ হয় না।
বন্ধু, নিউ ইয়র্কের ব্রঙ্কসে ২১শে ফেব্রুয়ারি মহা ধুমধামে পালন করার পেছনে যাদের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব, তাদের একজন ২২ শে ফেব্রুয়ারি নির্মম ভাবে খুন হন। সংবাদ মাধ্যমে নিশ্চই দেখেছ? হ্যাঁ, আমি জাকির খানের কথা বলছি। আমার সাথে ওনার ফেইসবুক বন্ধুত্ব অনেক দিনের। মাঝে মধ্যে অনুষ্ঠানে দেখা হলে ভাল মন্দ জানতে চাওয়ার বাইরে পরিচয় ছিল না। জাকির খানের মৃত্যু অবশ্যই তার পরিবার তথা বাঙালি সমাজের জন্য দুঃখজনক। আমি তার আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা ও পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা রেখেই বলছি, এটি একটি প্ররোচিত হত্যা।
এই দেশের মূলধারার সংবাদ মাধ্যমের মারফতে আমরা জানতে পেরেছি যে খুনি পেশাদার নয়। তবে জাকির খানের নামে অপরাধ কেস রয়েছে। খুনির নামে কোন কেইস নেই। এইসব তথ্যও মুলধারার পত্রিকায় এসেছে। আমার উদ্দেশ্য জাকির খানকে ছোট আর খুনিকে মহৎ দেখানোর জন্য নয়। আমার বক্তব্য অন্য জায়গায়। খুনের পরে অনেক মানুষ সামাজিক মাধ্যমে তাকে হিরো বানিয়ে পোস্ট দিয়েছে। আর খুনির ছবি দিয়ে তাকে পিচাশ, নরপিচাশ, শয়তান বানিয়ে শুধু থেমে নেই পুরা মিশরীয়দের গালি দিচ্ছে কারণ খুনি মিশরীয়। শুধু কি মিশরে থেমে আছে, পুরা আরব সমাজকে গালি দিচ্ছে নানা ভাষার ফুলঝুড়ি ছড়িয়ে। এত কথা, এত গলার জোর আসে কোথা থেকে?
অথচ দিনের পর দিন বিনা ভাড়ায় থাকা, বাড়িটি দখল করে থাকা ও বিক্রির নোটিশ দেওয়া সহ অনেক অভিযোগ আছে জাকির খানের বিরুদ্ধে। যখন জাকির খান এই বাড়ি দখল করে ভাড়া দিচ্ছিল না, এই বাড়িওয়ালা সমাজের মানুষ, সামজিক সংগঠন মসজিদ কমিটি, থানা পুলিশ, রাজনীতিবিদ সবার কাছে গিয়েছিল। একটা অন্যায় হতে দেখেও সবাই অন্যায়কে সমর্থন দিয়েছে বা চুপ থেকেছে। কেউ এই সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করেনি। ঐ বাড়িওয়ালা সেদিন তারপক্ষে কোন সহমর্মী পায় নাই। আইন কানুন ঠিকমত তাকে সাহায্য করে নাই। সব চেষ্টা ব্যর্থ হতে দেখে সে নিজেই নিজের প্রতিকার করেছে। আজ এই খুনের দায় শুধু খুনির নয় ঐ সব মানুষেরও যাদের দরজায় ঐ নিপীড়িত বাড়িওয়ালা কড়া নেড়েছিল।
আজ আপনাদের কারণে জাকির খান বেঁচে নেই। আপনারা পারতেন এই অন্যায় থেকে তাকে ফেরাতে, তাকে ফেরানোর চেষ্টা করতে। আপনারা খুনিকে গালি দিয়ে বন্ধুত্ব জাহির করছেন? খুনিকে ‘খুনি’ আপনারা আর জাকির খান বানিয়েছেন। তাই তাকে গালি দেয়ার অধিকার আপনাদের নেই। আর বন্ধু তো আপনারা মোটেও না, যে বন্ধুকে জেনে শুনে একটা একটা অন্যায় থেকে ফেরায় না সে কিসের বন্ধু? তাই দয়া করে ‘আহা’ ‘উহু’ করা বন্ধ করেন। আমার কথা তিতা হলেও সত্যি। মৃত মানুষ সব দোষগুণের উর্ধে চলে যায়। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন। আজ যদি বন্ধুত্ব দেখাতে হয়, মুসলিম সমাজের বিভাজন বন্ধ করুন। আরবীয় বা মিসরীয়দের গালি দিলে জাকির খানের আত্মা শান্তি পাবে না। জাকির খানের আত্মা শান্তি পাবে, তার তিনটি এতিম বাচ্চার দিকে নেকনজরে তাকালে, তাদের মাথায় স্নেহের হাত রাখলে, তাদের দুনিয়ায় চলার পথ মসৃণ করে দিলে।
যে খুনিকে আপনারা গালি দিচ্ছেন তার সমাজ তার উকিলের জন্য টাকা চেয়ে অনলাইনে ব্যাপক সাড়া পেয়েছে। তার বাচ্চাদের জন্যও হয়ত তার সমাজ এগিয়ে আসবে। আপনারা জাকির খানকে ভালোবাসলে তার পরিবারের পাশে দাঁড়ান। তারা যে শোক পেয়েছে এর জন্য তারা দায়ী নয়। তাদের শোক কাটিয়ে ওঠার শক্তি সাহস জোগান। তবেই বুঝব আপনি প্রকৃত বন্ধু। আপনারা যদি এই লেখার কারণে আমাকে শত্রু ভাবেন তাতে দুঃখ নেই। উচিৎ কথা বা ইনসাফের কথা আমি বাপকেও ছেড়ে বলব না। আমার সহানুভূতি দুই পরিবারের জন্য। অকারণে এই দুই পরিবারের মহিলা আর বাচ্চারা মুল্য দিল। আল্লাহ পাক তাদের সহায় হউক।
আজ এই পর্যন্ত। ভাল থাকো তুমি বন্ধু, ভাল থাকুক দেশ ও দেশের মানুষ।
ইতি
তোমার বন্ধু, যাকে তুমি কোন নামেই ডাকো না
কাজী ফৌজিয়া, মানবাধিকার কর্মী