‘মানুষ ব্যবহারের পর ফেলে দেয়ার বস্তু’

শাকেরা তাসনীম ইরা, ঢাকা:
ষাট থেকে সত্তরের দশকে নারীবাদীদের অভিধানে ‘সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশন’ নামক একটি টার্ম যুক্ত হয়। সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশন বলতে নারীকে তার ব্যক্তিত্ব এবং অনুভূতির বাইরে এনে শুধুমাত্র একটি শারীরিক বস্তু হিসেবে অন্যের সামনে তুলে ধরাকে বোঝায়। বর্তমানে আমাদের সমাজে হরহামেশাই নারীকে সেক্সুয়াল অবজেক্ট হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। আর এ কাজে আশঙ্কাজনক হারে অংশগ্রহণ করছে আমাদের টিভি মিডিয়া, অনলাইন মিডিয়া, মিউজিক ভিডিও, গানের কথা, বিজ্ঞাপন নির্মাতা এবং ফটোগ্রাফারগণ।
জার্নাল অব সেক্স রিসার্চ এর ২০১১ সালের ইস্যুতে প্রকাশিত পিটারসেনের এক গবেষণায় বলা হয়, ‘শারীরিক সম্পর্কের ব্যাপারে পুরুষ এবং নারীদের চিন্তা ও ব্যবহারে ভিন্নতা দেখা যায়। দৈহিক অন্যান্য চাহিদার মতই শারীরিক চাহিদার কথা নারীদের চেয়ে পুরুষরা দিনে প্রায় দ্বিগুণ বেশি চিন্তা করে।’
পুরুষের এ ধরণের চিন্তায় প্রভাব রাখে মূলত সস্তা পর্ণগ্রাফি, ফেসবুকের ১৮+ পেইজ ইত্যাদি। একজন পুরুষ যখন পর্ণগ্রাফি দেখেন তখন তার মস্তিষ্কের ভেতরে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই কিছু রাসায়নিক পদার্থের ধারাবাহিক ছুটোছুটি শুরু হয়ে যায়। পর্ণোগ্রাফিক ছবির প্রতি মস্তিষ্কের এই প্রতিক্রিয়া যখন শুরু হয়, মস্তিষ্ক তখন একে ‘সেক্সুয়াল কিউ’ হিসেবে ধরে নেয় যা কিনা একটা স্মৃতি হিসেবে ব্রেনের ভেতরেই রয়ে যায়! পরবর্তীরে সেই পুরুষটি তার সঙ্গীর সাথে হুবহু ঐ কাজটাই করতে চায়। সঙ্গী সেই চাহিদা পূরণ করতে রাজি না হলে কিংবা পূরণ করতে না পারলে তাদের সম্পর্কে চির দেখা যায়।
২০১২ সালে হাফিংটন পোস্টে একটা রিপোর্টে বলা হয়, ‘আজকাল ব্রেনের সামনে ছেলেদেরকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে আর মেয়েদেরকে যন্ত্রের মত পার্ট বাই পার্ট হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এতে করে ব্রেন সাধারণ ঘরোয়া মেয়েদেরকেও ‘সেক্সুয়াল পার্ট’ হিসেবে দেখতে শুরু করে!’
বর্তমানে আমরা বিভিন্ন পোশাক হাউজের বিজ্ঞাপনে দেখতে পাই নারীকে পোশাক রাখার অবজেক্ট হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। কিংবা বিজ্ঞাপনে মূল বস্তুর চেয়ে নারীর শারীরিক আবেদনকেই বেশি হাইলাইট করা হচ্ছে।
অ্যাটকিনের গবেষণায় দেখা গেছে যে ‘একটা মেয়ে শিশু সাধারণ বিজ্ঞাপন আর নিয়মিত টিভি প্রোগ্রামের মাঝে পার্থক্য করতে পারে না এবং তারা মার্কেটিং নামের বস্তুর নগ্ন শিকার হয়। এমনকি ৮ বছর বয়সের আগ পর্যন্ত সে বুঝতেই পারে না যে বিজ্ঞাপনের মূল উদ্দেশ্য আসলে ‘কেনা-বেচা’ সম্পর্কিত। ফলে টিভি কর্মাশিয়ালগুলোতে যখন সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশন চলতে থাকে, তখন কোনরকম ভুল-ঠিক বিচারের আগেই সে ঐ অবজেক্টিফিকেশনকে গ্রহণ করে ফেলে। আবার যখনই এই শিশু বড় হয়ে নিজের পরিচয় পায় তখনই সে নিজস্বতা হারিয়ে ফেলে।’
বর্তমানে বিভিন্ন গানের মিউজিক ভিডিও বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় সেখানে টিন এজ গায়িকা বা শিল্পীকে আঁট সাঁট পোশাক পড়িয়ে প্রাপ্ত বয়স্কদের মত উপস্থাপন করা হয়।অর্থাৎ সেক্সুয়াল রেডিনেস এর মাধ্যমে তার ম্যাচিউরিটিকে বোঝানোর প্রয়াস করা হয়।
আবার আমাদের বিভিন্ন গানের কথায় নারীকে ‘সেক্স’ করার বস্তু হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সেই আশির দশক থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন চলচ্চিত্রের গানে নারীকে আঁট সাঁট পোশাক পড়িয়ে নাচানো হচ্ছে ‘নাচ আমার ময়না তুই পয়সা পাবিরে’ থেকে শুরু করে ‘জাদু এ দুটি চোখে/ প্রেমের দোলা এ বুকে/ জাদু আমারই রূপে/ নেশায় ডুবিয়ে রাখে/ এ রাত এখনও বাকি/ আমি সে রাতেরই পাখি/ খুঁজে নাও না আমায়/ ভালবাসো আজ এ রাতে/ দিওয়ানা কত দিওয়ানা/ ঘুরে আগে পিছে হয়ে মাস্তানা/ ছোঁও না আমায়, ছোঁও না/ রাতের রানী আমি সোহানা’ এসব গানে।
এরই সাথে সাথে যখন বিভিন্ন মাধ্যমে নগ্নতা অনেকটাই সহজলভ্য তখন একজন পুরুষ চাইলে তার মুঠোফোনে একের পর এক তথাকথিত সুন্দরী এবং হট নারীর ছবি দেখতে পায়। সে চাইলেই একটা ছবি থেকে আরেকটা ছবিতে যেতে পারে নিজের খুশী মত। এই ধারণা মানুষের মধ্যে পরোক্ষভাবে যে ভাবনার উদয় ঘটায় তা হল মানুষ আসলে একবার ব্যবহারের পর ফেলে দেয়ার বস্তু।
সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশন একটি মেয়ের স্বকীয়তাকে নষ্ট করে দেয়। সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশনের শেষ পর্যায় হচ্ছে নারীকে সেক্সুয়ালি এবিউজ করা, ধর্ষণ এর মত ভয়াবহ দিকগুলি। সবচেয়ে আশঙ্কার দিক হল নারীর সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশনকে জেনে বা না জেনে খুব সহজ ভাবেই নিচ্ছে। যে কারণে মুন্নি, শিলা, সোহানার মত সেক্সুয়াল অবজেক্ট নিয়ে সাধারণ মানুষ আলোচনা করছে খুবই খোলাখুলি এবং নির্লিপ্ত ভাবে। এই ভয়ঙ্কর বিষয়ের স্থায়ীত্ব যদি আরো দীর্ঘ হয় তবে বেড়ে যাবে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, অল্প বয়সে মাতৃত্ব, মাতৃত্বকালীন নানান জটিলতা; এছাড়াও কমে যাবে বিশ্বাস, ভরসা, ভালোবাসার মত আবেগীয় সম্পর্কগুলো। আর সেক্ষেত্রে আমরা কি কখনোই হত্যা, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন মুক্ত সমাজ আশা করতে পারবো?
নিউজনেক্সটবিডি ডটকম/টিএস