
ঢাকা: গরীব ঘরের একটি মেয়ে। পেটের টানে নিজেকে পুঁজি করে বিদেশের মাটিতে পাড়ি জমিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল পরিবারের দু:খ দুর্দশা দূর করা আর নিজের উজ্জল ভবিষ্যৎ গড়া। সুখ খুঁজতে গিয়ে তাকে সাক্ষী হতে হয়েছে পৈশাচিক নির্যাতনের।
শনিবার দুপুরে রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে ‘নিরাপদ অভিবাসন এবং মানবপাচার প্রতিরোধ’ শীর্ষক এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ (বায়রা) ও র্যাব ফের্সেস যৌথভাবে সেমিনারটি আয়োজন করে।
সেমিনারে অংশ নিয়ে নিজের জীবনের এই করুণ কাহিনী তুলে ধরেন সিরিয়া ফেরত পটুয়াখালীর ওই মেয়েটি। সেখানে তিন মাস আটকে রাখা হয়েছিল তাকে। চাইলেও সব সময় খেতে দেয়া হতো না।
এক পর্যায়ে তাকে একটি পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়া হয়। সেখানে শরীরে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে নির্যাতন করা হতো। কোনো একদিন সুযোগ পেয়ে বাড়ি ফোন করে মায়ের কাছে সব খুলে বলে। পরে তার মা র্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।
অনুষ্ঠানে নিজের ভাগ্যকে দালালের হাতে সমর্পণ করার গল্প শোনান ফরিদপুরের মুহিব উল্লাহ। মাদারীপুরের শিবচর এলাকার বেলায়েত নামের একজনের কথায় গত বছরের ১০ মার্চ দক্ষিণ আফ্রিকায় পাড়ি জমান মুহিব। সেখানে বেলায়েতের দোকানে তার চাকরি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চাকরি তো মেলেইনি, বরং পাকিস্তানিদের মাধ্যমে জিম্মি হতে হয় তাকে।
আরো পড়ুন: সুখের ফাঁদে পড়ে দালালের হাতে ভাগ্য সমর্পণ
তারা মুহিবের পরিবারকে ১০ লাখ টাকা পাঠাতে বলে। অন্যথায় তাকে খুন করা হবে বলে হুমকি দেয়। মুহিবের দরিদ্র পরিবার টাকা পাঠাতে না পারায় তার উপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। কখনো বৈদ্যুতিক শক দেয়া হয় আবার কখনো গরম পানি। পানি ছাড়া তাকে কিছুই খেতে দেয়া হতো না। পরে তার বাড়ির লোকজন র্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করলে র্যাব ও চয়ন নামে এক বাংলাদেশির সহযোগিতায় গত ২ এপ্রিল দেশে ফেরেন মুহিব।
ভুক্তভোগীদের এমন করুণ দুর্দশার গল্প শুনে অনুষ্ঠানে উপস্থিত অনেকেই চোখ মুছছিলেন। পরে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, ‘মানব পাচারকারীরা দেশের শত্রু। তাদের প্রতিরোধে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের একজন নারী বিদেশে গিয়ে নির্যাতিত হবেন, এটা কোনোভাবেই মানা যায় না। এসব বন্ধে আমাদের কাজ করতে হবে। আমরা এমন নির্যাতনের আর কোনো ঘটনা শুনতে চাই না।’
তিনি বলেন, ‘আমি মালদ্বীপে গিয়ে দেখি অনেক লোক রাস্তায় শুয়ে আছে। কাজ নেই। দূতাবাস থেকে বলা হয়, এরা বৈধভাবে আসেনি। আরেক দেশে গিয়ে শুনি সেখানকার জেলে আটশ বাংলাদেশি। সাগরপথে হাজার হাজার মানুষ গেছে। থাইল্যান্ড বা মালয়েশিয়ার জঙ্গলে অনেকের গণকবর মিলেছে। আমরা চাই না এগুলো থাকুক।’
মন্ত্রী বলেন, ‘এই ধরনের যেকোনো কিছু ঘটলেই মানুষ জিজ্ঞেস করে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কী করে? সে কারণেই আমাদের কাজ করতে হয়। র্যাব এ কারণেই মানব পাচার প্রতিরোধে কাজ করছে। সবাই মিলে সুসংগঠিতভাবে কাজ করতে হবে।’
র্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘মানব পাচার বন্ধে অপরাধীদের শাস্তি ১২ বছর জেল যথেষ্ট নয়, তাদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত।’
তিনি বলেন, ‘দেশের এক শ্রেণির অসাধু দালাল চক্র স্বল্প আয়ের মানুষদের টার্গেট করে বিদেশে পাচার করছে। এর সঙ্গে আর্ন্তজাতিক মানব পাচার চক্র জড়িত। পাচারের শিকার সাধারণ মানুষকে তারা পৃথিবীর বিভিন্ন বন-জঙ্গলে জিম্মি করে রাখে। পাচারের শিকার মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। তাদের অনেকেই নির্যাতিত হয়ে মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছে।’
র্যাবের ডিজি বলেন, ‘এ চক্রটি প্রতারণার ফাঁদে ফেলে অনেক নারীকেও বিদেশে পাচার করছে, তাদের পতিতাবৃত্তি করতে বাধ্য করছে। আমাদের দেশের অনেক নিরীহ মানুষ নিজের জায়গা জমি বিক্রি করে বিদেশ যায়। সেখানে গিয়েও তারা নির্যাতনের শিকার হয়। এমনকি অনেকে মৃত্যুর মুখে পতিত হয়। এ কারণে মানব পাচারকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া উচিত।’
অনুষ্ঠানে র্যাব-৩-এর কমান্ডিং কর্মকর্তা তুহিন মোহাম্মদ মাসুম মানব পাচার প্রতিরোধে র্যাবের বিভিন্ন কার্যক্রম ও সুপারিশ তুলে ধরেন। বায়রার সাবেক সভাপতি নুর আলী ও বর্তমান মহাসচিব রুহুল আমিন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন। তারা অযথা ব্যবসায়ীদের যেন হয়রানি না করা হয়, সে জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানান। অনুষ্ঠানে পাচার হয়ে ফিরে আসা ১০ জনকে এক লাখ টাকা করে দেয়া হয়।
সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নূরুল ইসলাম বিএসসি। এছাড়া বায়রার সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য বেনজির আহমদ ও বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সিজ মালিকরা উপস্থিত ছিলেন।
প্রতিবেদন: প্রীতম সাহা সুদীপ, সম্পাদনা সজিব ঘোষ