Tuesday, September 26th, 2023
যাপনে নয়, জীবন উদযাপনের
April 4th, 2019 at 5:42 pm
যাপনে নয়, জীবন উদযাপনের

রিমি রুম্মান, কুইন্স, নিউইয়র্ক ;

স্বপ্নের দেশে আমাদের যাপিত জীবন কেমন চলছে এমন প্রশ্নের উত্তরে কেউ কেউ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে, ‘ধুর এটা কোন জীবন হোল?’ আমার এক বন্ধু পরবাসের কঠিন বাস্তবতায় প্রায়শই হতাশার সাথে বেশ দুঃখিত স্বরে বলতো, ‘যে জীবন আমি যাপন করছি তাকে কোন জীবন বলে না’। তবে কেউ কেউ সৃষ্টিকর্তাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ্‌ অনেক ভালো আছি’।

এই ভালো থাকার বিষয়টা একান্তই নিজের। আমাদের ভালো থাকার পথ তৈরি করে নিতে হয়। যে দিন চলে যায় একবার, তা আর ফিরে না কখনো। একটাই তো জীবন। একে যাপন নয়, উদযাপন করার মানসিকতা নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। কেননা অন্ধকার যতই গভীর হোক না কেন, আলোর কিরণ তাকে ধুয়ে দেয়। তবুও পরবাস জীবন কারো কাছে স্বস্তির নিঃশ্বাস, কারো কাছে দীর্ঘশ্বাস।  

এই তো ক’দিন আগের কথা। তখন ফেব্রুয়ারির শেষভাগ। বাহিরে কনকনে শীত। ক’দিন বিরতি দিয়ে দিয়ে তুষারপাত চলছিল। আচমকা বলা নেই, কওয়া নেই আমার নিউইয়র্কের বাড়িতে দেশ থেকে অতিথি এসে হাজির। এক সময় ভদ্রলোক আমার ভাড়াটিয়া ছিলেন। আবার দূর সম্পর্কের একরকম আত্মীয়ও হন। সেই অধিকারে আবদারে মাঝে মাঝেই এমন হুটহাট এসে হাজির হন।

নিউ ইয়র্ক

তিনি দুই যুগেরও অধিক সময় এই নিউইয়র্ক শহরে ব্যাচেলর জীবন যাপন করেছেন। কঠোর পরিশ্রম করেছেন। দীর্ঘদিন ট্যাক্সি ক্যাব চালানো পেশার সাথে জড়িত ছিলেন। বয়স এবং শারীরিক নানাবিধ অসুস্থতা নিয়ে অবশেষে বিদেশের পাট চুকিয়ে একেবারেই ফিরে গিয়েছিলেন দেশে পরিবারের কাছে। মেডিকেল চেকআপ কিংবা কাগজপত্র সংক্রান্ত প্রয়োজনে মাঝে মধ্যে এদেশে আসেন। কাজ শেষে আবার ফিরেও যান দেশে।

এই স্বল্পকালীন সময়ে তিনি আমার অতিথি হন। প্রতিবার সোশ্যাল সিকিউরিটি অফিসে একাই ছুটোছুটি করতেন। কিংবা সময় পেলে আমিও নিয়ে যেতাম এখানে ওখানে। আমেরিকার নাগরিকত্ব নিয়েছেন অনেক আগেই। তবে এবারের আসাটা ছিল অন্যবারের তুলনায় একেবারেই ভিন্ন।

সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে পুত্রের কাঁধে ভর দিয়ে তিনি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসেন যখন, তখন বড় বড় শ্বাস নিচ্ছিলেন। চোখ দুটি রক্তলাল। কারো সাহায্য ছাড়া দাঁড়াতে পারছিলেন না। সাথে হুইল চেয়ার। আমরা ঘাবড়ে যাই। এমন জীবন মৃত্যুর মাঝামাঝিতে থাকা একজন অসুস্থ মানুষ কেমন করে ১৮/২০ ঘণ্টার আকাশ ভ্রমন করে এই বিদেশ বিভূঁইয়ে এলেন, তা ভেবে শিউরে উঠি। আমরা পরিবারের প্রতিটি সদস্য ঘরের কমলা আলোয় একে অপরের চিন্তাক্লিষ্ট মুখ চাওয়া চাওয়ি করছিলাম।

শেষে  জানলাম, বাংলাদেশে তিনি আইসিইউতে ছিলেন। ডাক্তাররা তার জীবনের সকল আশা ছেড়ে দিয়েছেন। একাধারে হার্ট, কিডনি, লিভারের সমস্যায় ভুগছেন তিনি। আর তাই বেঁচে থাকবার শেষ প্রচেষ্টায় ক্ষীণ আশা নিয়ে উন্নত চিকিৎসার উদ্দেশ্যে আকাশযানে চেপে বসেন পিতা এবং আঠারো বছরেরও কম বয়েসি পুত্র।

রাতেই আমরা এ্যাম্বুলেন্স কল করে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে পাঠাতে চাইলাম। তিনি যেতে রাজি হলেন না। রাতটা ভয় আর আতংকে কাটে আমাদের। পরদিন যথারীতি তার ইচ্ছানুযায়ী হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় সেখানে ভর্তি করানো হোল। সেই থেকে গত এক মাসেরও অধিক সময় তিনি কখনো হাসপাতালে কখনোবা রিহাবে অবস্থান করছেন। শারীরিক অবস্থা কিছুটা উন্নতি হলেই রিহাবে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। আবার অবনতি হলে জরুরি ভিক্তিতে হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। স্ত্রী এবং পরিবারের অন্য সদস্যরা বাংলাদেশে। কেননা তাদের এদেশে আসবার বৈধ কাগজপত্র কিংবা অনুমতি নেই। সময়টাকে ‘জীবনের পড়ন্তবেলা’ নাকি ‘জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ’ বলব, ঠিক বুঝে আসে না।

আগেরবার যখন এসেছিলেন তিনি, তখনকার কথা। জীবনের প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি নিয়ে গল্প হয়েছিল বেশ। কথা প্রসঙ্গে বলেছিলাম, ফেলে আসা জীবনে ফিরে যাবার সুযোগ থাকলে কোন ভুলটি শুধরে নিতেন, এসব নিয়ে। বলেছিলেন, বিয়েটাই ভুল ছিল, কিংবা ভুল মানুষের সাথে সম্পর্ক টেনে নিয়ে গিয়েছেন গোটা একটা জীবন। কেননা, স্ত্রীকে এদেশে আনবার ব্যপারে কোনভাবেই রাজী করাতে পারেননি তিনি। স্ত্রীর সাফ কথা, তিনি দেশেই থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।

স্ত্রী, সন্তান নিয়ে সুন্দর একটি জীবন হতে পারতো এদেশে তার। কিন্তু হয়নি। বাধ্য হয়েই পরিবারের সান্নিধ্য পাবার জন্যে বছরের ক’মাস দেশে, আর রুটি-রুজির তাগিদে বাকীটা সময় বিদেশে কাটাতে হয়েছে। এতে না পেরেছেন কাছে থেকে সন্তানদের সঠিকভাবে মানুষ করতে, না পেরেছেন ভালো আয়-রোজগার করে জীবনটাকে সুন্দরভাবে সাজাতে।

গল্পে গল্পে ন্যাশনাল এভিনিউয়ের রেড লাইটে এসে থেমেছিলাম আমরা। আমি ফিরে ফিরে চেয়েছিলাম গাড়ির যাত্রীর আসনে বসা জীবন সংগ্রামে লড়াকু একজন মানুষের দিকে। চোখে মুখে বিষাদের ছায়া ছিল। বলেছিলেন এক জীবনের টুকরো টুকরো অনেক কথা। উপরে উঠার সুযোগগুলো একে একে কেমন করে হাতছাড়া হলো, শুধু এই পিছুটানের কারণে। সামনের প্রশস্ত রাস্তায় শত শত গাড়ির ছুটে চলার দিকে চেয়ে ছোট্ট শ্বাস নিয়ে বলেছিলেন, ‘দোটানা, আর টানাহেঁচড়ার জীবনে উঠে দাঁড়ানো কঠিন, খাড়া পাহাড়ে উঠার চেয়েও কঠিন।’

আমার চেনা আরেকজন বড়ভাই আছেন ঠিক বিপরীত। তিনি ম্যানহাঁটনের ফুটপাতে গাড়িতে ফলের ব্যবসা করেন। অনেকটা আমাদের দেশের চটপটি, ফুচকার গাড়ির মতন। স্বাধীন ব্যবসা। বছরের কন্‌কনে শীতের তুষারপাতের সময়টা দেশে পরিবারের সান্নিধ্যে কাটান। বাকি আট মাস এই নিউইয়র্ক নগরীতে। একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন তার স্ত্রী এদেশে আসতে উদগ্রীব। স্বামী সন্তান নিয়ে একসাথে এই বিশ্বের রাজধানীখ্যাত শহরে বসবাস করবেন, সংসার সাজাবেন, সেই স্বপ্ন দেখেন প্রতিনিয়ত। আমি বলেছিলাম, এটাই স্বাভাবিক। সকল নারীই এমন স্বপ্ন লালন করে বুকের গহিনে।

এক বিকেলে থার্টি সেভেন এভিনিউতে দেখা হতেই বলেছিলাম,’ কী রহমান ভাই, ভাবী আর বাচ্চারা কবে আসবে? ‘ তিনি একগাল হেসে বলেছিলেন, ‘মাইয়া মানুষ এই দ্যাশে না আনাই ভালো। বেশি স্বাধীনতা পাইলে চোখ উলটাইয়া ফালাইবো।’ আমি বিস্ময়ে বলে উঠেছিলাম, ” কিহ্‌!” এবার তিনি আরেকটু প্রশস্ত হাসি হেসে বলেছেন, ‘ বুঝেন নাহ্‌! এইখানে আসলে পাখ্‌না গজাইবো, উড়াল দিতে চাইবো।’ ততোক্ষণে শেষ বিকেলের নিরুত্তাপ আলো মিলিয়ে যেতে যেতে সন্ধ্যার আঁধার ঘনায় নগরীতে ।

রাস্তার নিয়ন বাতিগুলো জ্বলে উঠে একে একে। অজস্র মানুষের ভিড়ে ব্যস্ত হয়ে উঠা আমি ভাবি, এটিই প্রবাস। রঙবেরঙের মানুষের দৃশ্যত রঙিন প্রবাস। কারো স্বস্তির নিঃশ্বাসের উল্টোপিঠে কারো দীর্ঘশ্বাস! কিংবা, এভাবেও বলা যেতে পারে,পৃথিবীর কোথাও যখন এক আকাশ আলো ছড়িয়ে জ্যোৎস্নায় মাখামাখি হয়ে উঠে, অন্য কোথাও তখন চারিপাশ আঁধার করে বৃষ্টি নামে।

রিমি রুম্মান ,
কুইন্স, নিউইয়র্ক


সর্বশেষ

আরও খবর

রিয়াদ ও ঢাকার মধ্যে সম্ভাব্য সকল ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াানোর পক্রিয়া চলমান

রিয়াদ ও ঢাকার মধ্যে সম্ভাব্য সকল ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াানোর পক্রিয়া চলমান


বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিরা মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ না দিলে খুনিরা বঙ্গোপসাগরে ভেসে যেতো: আইনমন্ত্রী

বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিরা মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ না দিলে খুনিরা বঙ্গোপসাগরে ভেসে যেতো: আইনমন্ত্রী


মতিয়ার রহমানের কবিতা

মতিয়ার রহমানের কবিতা


পানের রাজ্য মহেশখালীতে নির্মিত হচ্ছে দৃষ্টিনন্দন পান ভাস্কর্য

পানের রাজ্য মহেশখালীতে নির্মিত হচ্ছে দৃষ্টিনন্দন পান ভাস্কর্য


১৫ আগস্ট মিলনের গল্প ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’ মঞ্চে আসছে

১৫ আগস্ট মিলনের গল্প ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’ মঞ্চে আসছে


প্রধানমন্ত্রী রংপুরে ১২৪০ কোটি টাকা ব্যয়ের বিভিন্ন প্রকল্প উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন

প্রধানমন্ত্রী রংপুরে ১২৪০ কোটি টাকা ব্যয়ের বিভিন্ন প্রকল্প উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন


বর্তমান পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি অসাংবিধানিক ও বেআইনি : পর্যবেক্ষক টেরি এল ইসলে

বর্তমান পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি অসাংবিধানিক ও বেআইনি : পর্যবেক্ষক টেরি এল ইসলে


চকরিয়ায় কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের পর ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে তরুণ আটক

চকরিয়ায় কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের পর ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে তরুণ আটক


সুদানের একটি গণকবরে ৮৭টি মরদেহ

সুদানের একটি গণকবরে ৮৭টি মরদেহ


ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২৯৯

ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২৯৯