
মুহাম্মদ আব্দুস সাত্তার, লন্ডন;
কি অপার্থিব আলোয় ছেয়ে আছে চারদিক। মধুর ভালোবাসায় আচ্ছন্ন আজ জগতের সব কিছু। কি প্রবল শক্তিতে এখন উত্থিত আমরা সবাই। সে এসেছে, দু’হাত বাড়িয়ে আমরা তাকে জড়িয়ে নিই পরম মমতায়।
কতো দিন, কতো রাত কেটেছে তার অপেক্ষায়। অপেক্ষা ছিলো মুক্তির স্বপ্নে প্রত্যয়ী সকল যোদ্ধার প্রতিটি দৃপ্ত নি:শ্বাসে; মুক্তিযোদ্ধার ধাতব অস্ত্রের শত্রু-সংহারী নিনাদে; দগ্ধ-বিধ্বস্ত-ক্ষতবিক্ষত জনপদে; লাঞ্ছিত জীবন আর বিবর্ণ জমিনের আর্তিতে; বন্দী শিবিরে নির্যাতিত-নিহত প্রতিটি মানুষের রক্তের ফোঁটায়; সব উৎপীড়িত নারীর অসহায় হাহাকারে, জায়নামাজে সেজদায় ঝরে পড়া আকুল প্রার্থনায়, সব শহীদের কবরের কুটিরে।
যুদ্ধ এবং প্রার্থনায় আকুতি ছিলো স্বাধীনতার। অবশেষে এই দিন এসেছিলো এই স্বাধীনতা। ১৬ই ডিসেম্বর বৃহষ্পতিবার। রক্তের ভেলায় চড়ে শীতের বিকেলে, কোমল আলোয় স্নাত হয়ে স্বাধীনতা সেদিন আমাদের হয়েছিলো।
সেদিন তার সাথী ছিলো ৩০ লাখ শহীদের স্বপ্ন ও শোণিত; দু’ লাখ উৎপীড়িত মা-বোনের শুভাশিস; সাথী ছিলো বাঙালির যুদ্ধজয়ের গৌরব আর সেই গৌরবের অমর জয়ধ্বনি: জয় বাংলা।
মধ্য ডিসেম্বরের সেই অবিস্মরণীয় দিনটি আধুনিক ইতিহাসে বাঙালির প্রথম স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের কাঠামোটি শত্রুমুক্ত করে সুপ্রতিষ্ঠিত করে দেয়। বাঙালির এই রাষ্ট্র-সংগ্রামের স্বপ্নদ্রষ্টা আর রূপকার – এই দুই ভূমিকার জন্যেই ইতিহাস বেছে নিয়েছিলো শেখ মুজিব নামের এক অসীম সাহসী বাঙালিকে। বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সর্বস্ব পণ করেছিলেন তিনি, ছাপিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর পূর্বসূরী আর সমসাময়িক সব রাজনৈতিক নেতাকে। শেখ মুজিবের কাছেই বাঙালি নির্ভরতা খুঁজে পেয়েছিলো, তাই তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলার বন্ধু – বঙ্গবন্ধু।

১৬ ডিসেম্বরের সাথে জড়িয়ে আছে অশ্রুসজল কিন্তু গৌরবে উজ্জ্বল এক দুর্বার সংগ্রামের ইতিহাস। স্বাধীনতার এই চ‚ড়ান্ত অধ্যায়ে বঙ্গবন্ধু একই সাথে সৃষ্টি করেছেন অনেক ইতিহাস। এক জীবনে এতোগুলো ইতিহাসের স্রষ্টা হতে পারার নজির দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যায় না।
বিপুল বৈরী সময়ে প্রথমে স্বেচ্ছাচারী একনায়ক (আইয়ুব খান) এবং পরবর্তীতে সামরিক শাসকচক্র (ইয়াহিয়া ও তার ঘাতক বাহিনী) ও তাদের সহযোগি রাজনৈতিক চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে তিনি লড়ে গেছেন অসাধারণ বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা নিয়ে। তাঁর প্রজ্ঞাময় নেতৃত্ব জাতিকে অবিচলভাবে পৌঁছে দিয়েছে স্বাধীনতার মোহনায়, এরপর ‘আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
এই ইতিহাসগুলো আজকের এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে স্মরণ করার তাগিদ রয়েছে ইতিহাসের স্বার্থে।
জাতীয় স্বাধীনতার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণ ও সফল নেতৃত্বের অসাধারণ পর্বসমূহ:
এক. ৬-দফার দাবিতে সারা দেশে গণজোয়ার সৃষ্টি
বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে ৬-দফার দাবীতে নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলনের মাধ্যমে জাতিকে প্রস্তুত করেছেন স্বাধীনতার লক্ষ্যে। সারা দেশ জুড়ে অবিরাম ঘুরে ঘুরে গণজাগরণ সৃষ্টি করেছেন, যা এক সময়ে পরিণত হয় টসবগে গণজোয়ারে।
এর এক পর্যায়ে তাঁর বজ্রকন্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করা এবং চিরতরে বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রাম নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র আঁটে পাকিস্তানী শাসকচক্র। তাঁকে ফাঁসিতে নির্মূল করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুকে তারা রাষ্ট্রদ্রোহিতার ভুয়া অভিযোগে প্রধান অভিযুক্ত করে দায়ের করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। কিন্তু শেখ মুজিবকে নির্মূলে তারা সক্ষম হয়নি।
দুই. ফাঁসির সেলে থেকেও অসাধারণ বীরত্বে সফল গণ-অভ্যুত্থান
পাকিস্তানীদের সামরিক ছাউনিতে বন্দী, ফাঁসির মুখোমুখি অটল শেখ মুজিবের অসাধারণ বীরত্ব, অসীম সাহসে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে সমগ্র জাতি। ফলে ১৯৬৮-৬৯ এ দুর্বার গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানী শাসকচক্র।

তিন. নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সাংবিধানিকভাবে জাতীয় নেতার আসনে অধিষ্ঠান
১৯৬৬ সালে সূত্রপাত হওয়া দুর্বার ৬-দফা আন্দোলন থেকে ১৯৬৯-এর সফল গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত এই তিন বছরের সময়কালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জাতির একচ্ছত্র নেতার আসনে অধিষ্ঠিত হন। তার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের প্রথম ও একমাত্র সাধারণ নির্বাচনে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সেই নির্বাচনে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পার্লামেন্টের মোট ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের (আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের) জন্যে নির্ধারিত মোট ১৬২ আসনের ১৬০টিতেই বিজয়ী হয়। ফলে সাংবিধানিকভাবে তিনি জাতীয় নেতার আসনে অধিষ্ঠিত হন। তাঁরই গঠন করবার কথা ছিলো পাকিস্তানের জাতীয় সরকার। এই নির্বাচন তাঁকে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠির একমাত্র নেতা ও মুখপাত্র হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করে।
চার: নির্বাচন-পরবর্তীকালে শাসকচক্রের নতুন চক্রান্তের মোকাবেলা
কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলা ও তাদের সহযোগি রাজনীতিবিদরা গণতন্ত্রে কখনোই বিশ্বাসী ছিলো না, তাই জনগণের রায় মেনে বাঙালি শেখ মুজিবের হাতে দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার হস্তান্তরের কোন ইচ্ছেই ছিলো না তাদের। যে কোন পরিস্থিতিতে তারা বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা দাবী কাটছাঁট করে তাঁকে তাদের বশংবদ করার চেষ্টা চালাতে থাকলো। সেই কঠিন সময়েও বঙ্গবন্ধু অসাধারণ বিচক্ষণতার স্বাক্ষর রেখে পাকিস্তানী শাসকচক্র ও তাদের দোসরদের নতুন নতুন চক্রান্ত মোকাবেলা অব্যাহত রাখলেন বুদ্ধিদীপ্ত কৌশলের সাথে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে তাঁর সাথে বৈঠকে বসতে বসতে চাইলে বঙ্গবন্ধু তার সাথেও আলোচনা চালিয়েছেন দিনের পর দিন। এর আগে তিনি তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ সামরিক দুষ্কৃতকারীদের প্রধান দোসর জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথেও বৈঠকে বসেছেন। এভাবে তিনি সে সময়কার সব গুরুত্বপূর্ণ পক্ষগুলোর সাথেই সমান তালে যুঝেছেন।
পাঁচ: ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলন আর মুক্তির যুদ্ধ-প্রস্ততির ডাক
নবনির্বাচিত পাকিস্তান পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা ছিলো ঢাকায় ৭১-এর ৩ মার্চ। কিন্তু শাসকচক্রের ষড়যন্ত্রের এই শেষ পর্বে সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ ওই অধিবেশন স্থগিত করে দেন। এই ঘোষণা আসার পর মুহূর্ত থেকে গোটা বাংলাদেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। শ্লোগান উঠলো ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’।
৭ মার্চ রোববার ঢাকার রেসকোর্স ময়দান। বঙ্গবন্ধু এলেন সভামঞ্চে। ১৮ মিনিটের দৃপ্ত ভাষণে তিনি পাকিস্তানের সমরযন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করে বাংলাদেশের (পূর্ব পাকিস্তানের) শাসনভার তুলে নিলেন নিজের হাতে। ঘোষণা দিলেন সামরিক সরকারের সাথে অসহযোগিতার-অসহযোগ আন্দোলনের।
সব শেষে মানুষের নেতা, রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু সেদিনের সেই অমর ভাষণের শ্রেষ্ঠতম পংক্তি দুটো উচ্চারণ করলেন, বললেন: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
আরও বললেন: ‘আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি, যার যা কিছু আছে তা-ই নিয়ে শত্রু মোকাবেলা করতে হবে। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ’।
স্বাধীনতার অভিযাত্রার এই প্রতিটি পর্বে বঙ্গবন্ধু নিয়মতান্ত্রিক ধারা বজায় রেখে জাতিকে নিয়ে গেছেন স্বাধীনতার মোহনায়। আর ৭ মার্চ তিনি সর্বপ্রথম ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি উচ্চারণ করে সেজন্যে সশস্ত্র প্রস্তুতি নেয়ার ডাক দিয়েছেন।

ছয়: স্বাধীনতার ঘোষণা আর মুক্তির যুদ্ধ
৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ। ১৮ দিনের ব্যবধানে বাংলাদেশের স্বাধিকারের আন্দোলন স্বাধীনতার যুদ্ধের দিকে গড়িয়ে যায়। ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের বাঙালি জোয়ানদের বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও বাংলাদেশের জনমানুষের জীবন তখন চিরদিনের মতো এক সূত্রে গ্রন্থিত হয়ে যায়।
স্বাধীনতার এই প্রত্যক্ষ লগ্ন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু কারাগারের ভেতরে বা বাইরে যেখানেই থাকুন না কেন, যেভাবে জাতির প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি বিচক্ষণতার সাথে নেতৃত্ব দিয়েছেন, স্বাধীনতার যুদ্ধকালেও তিনিই সেভাবেই ছিলেন জাতির সর্ব্বোচ্চ নেতা। শেখ মুজিবেরর নামেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে, তিনিই ছিলেন স্বাধীন বাংলার প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু গণজারণে সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন, গণজোয়ার সৃষ্টিতে সফল নেতৃত্ব দিয়েছেন, পার্লামেন্ট নির্বাচনে অনন্যসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছেন, পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক-রাজনৈতিক চক্রান্তকারীদের সাফল্যের সাথে মোকাবেলা করেছেন, সামরিক শাসকদের চ্যালেঞ্জ করে অসহযোগ আন্দোলন সফল করেছেন, সেই শাসকচক্রের বিরুদ্ধে অকুতোভয়ে রুখে দাঁড়িয়ে দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এবং সেই স্বাধীনতার যুদ্ধে হয়েছেন একমাত্র প্রেরণা-শক্তি। নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামি রাজনীতিবিদ আর তুখোড় সমর-কুশলী-এ দু’য়ের সমন্বয় ঘটেছিলো বঙ্গবন্ধুর মধ্যে অভাবিতভাবে।
এক জীবনে এতো সাফল্য মূলত একজন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিবিদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সাফল্যের বরপুত্ররূপে ইতিহাস তাঁকে নির্বাচিত করেছিলো। বঙ্গবন্ধু ইতিহাসকে হতাশ করেননি।
বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে আমাদের স্বাধীনতা এসেছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়েই আমাদের স্বাধীনতা থাকবে।

১৬ ডিসেম্বর ২০২০