
প্রীতম সাহা সুদীপ, ঢাকা: কেউ ছিলেন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, কেউ মসজিদের মুয়াজ্জিন, আবার কেউ সিমেন্ট কোম্পানির সেলস রিপ্রেজেনটেটিভ। কিন্তু একটা সময় কোন না কোন ভাবে তারা সকলেই জড়িয়ে পড়েন জঙ্গি কার্যক্রমে। হয়ে উঠেন নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির প্রশিক্ষক, বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ ও অর্থসমন্বয়কারী।
রাজধানীর বিমানবন্দর রেলস্টেশন এলাকায় অভিযান চালিয়ে বুধবার রাতে মাওলানা আব্দুল হাকিম ও রাজীবুল ইসলাম নামে দুই জেএমবি সদস্যকে গ্রেফতার করে র্যাব-পরে তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে আদাবরে মোহাম্মদিয়া ক্যাফে থেকে সোহেল রানা, গাজী কামরুস সালাম সোহান ও আবু সালেহ নামে আরো তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। উদ্ধার করা হয় অস্ত্র-গুলি ও বিস্ফোরক সরঞ্জাম।
র্যাব জানায়, গ্রেফতারকৃতরা সবাই জেএমবির ‘সারোয়ার-তামিম’ গ্রুপের সদস্য। সারোয়ার জাহান ওরফে শাইখ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ এবং তামিম চৌধুরী সহ জেএমবির কয়েকজন শীর্ষ নেতা নিহত হওয়ায় গ্রুপটি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। তবু তাদের সদস্যরা সংগঠনকে চাঙ্গা রাখতে অতি গোপনে সংঘবদ্ধ হওয়ার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।
তারা জানায়, গ্রেফতারকৃত পাঁচ জঙ্গি অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুটপাটের জন্য থানায় আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেছিল। নির্দিষ্ট থানায় কি পরিমাণ অস্ত্র-গোলাবারুদ আছে এবং কার কখন ডিউটি বদল হয়, তা জানার জন্য এজেন্টও নিয়োগ করা হয়েছিল।
কিভাবে ওই পাঁচজন জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়লেন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সেসব তথ্যও পেয়েছেন র্যাবের গোয়েন্দারা। জেএমবির গ্রেফতার হওয়া পাঁচ সদস্যের একজনের নাম গাজী কামরুস সালাম ওরফে সোহান ওরফে আবু আব্দুল্লাহ। তিনি পেশায় একজন ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, জন্ম স্থান যশোর। ২০০৭ সালে মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে গাজীপুরের ইসলামী ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি থেকে ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক্সে বিএসসি সম্পন্ন করেন।
মূলত ইসলামী ইউনিভার্সিটিতে অধ্যায়নরত সময়ই কলেজ বন্ধু আত্-তামকিন জঙ্গি সাইটের এ্যাডমিন ইঞ্জিনিয়ার মোস্তাফিজুর রহমান সিফাতের মাধ্যমে জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন সোহান। সিফাতসহ ছয় জনকে সম্প্রতি গ্রেফতার করেছে র্যাব-৪। সে সময় সোহান প্রায়ই হাতেমবাগে জসীম উদ্দিন রাহমানির মসজিদে যাতায়াত করতেন। মসজিদে একই মতাদর্শের কয়েকজনের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। ২০১৩ সাল থেকে জঙ্গিবাদ তার ভিতরে দৃঢ়ভাবে জায়গা করে নেয়। পরে সিফাত তাকে জেএমবির ‘সারোয়ার-তামিম’ গ্রুপে অন্তর্ভূক্ত করে এবং সারোয়ারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।
সোহানকে চট্রগ্রামে ক্ষুদ্রাস্ত্র ও বোমা বানানোর প্রশিক্ষণের জন্য প্রেরণ করা হয়। তবে তার মূল কাজ ছিল বিভিন্ন হামলা/নাশকতার জন্য কারিগরী সহায়তা যেমন বিস্ফোরক তৈরি ও প্রশিক্ষণ প্রদান। তার আরো একটি প্রধান দায়িত্ব ছিল বিভিন্ন স্থান থেকে অর্থ যোগান দেয়া। একই রকম মদদপুষ্ট ব্যক্তি যারা বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মরত আছেন তাদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করা। এছাড়া তিনি নিজেও জঙ্গিবাদ অর্থায়নে নিজস্ব অর্থ প্রদান করতেন।
‘সারোয়ার-তামিম’ গ্রুপের আরেক সদস্যের নাম মাওলানা আব্দুল হাকিম ফরিদী ওরফে সুফিয়ান। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মাদ্রাসা লাইনে পড়াশোনা শুরু করেন, ১৯৯৭ সালে খিলগাঁওয়ের মাখাবাপুর উলুম মাদ্রাসায় দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স সম্মান) সম্পূর্ণ করেন। তিনি একজন ভালো বক্তা ও প্রশিক্ষক ছিলেন। এক পর্যায়ে জসীমউদ্দিন রাহমানির মাধ্যমে তিনি জঙ্গিবাদে অনুপ্রাণিত হন। একাধিক মজলিসে জসিম উদ্দিন রাহমানির সঙ্গে বক্তৃতাও দিয়েছেন। এক সময় তিনি আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের শীর্ষ পর্যায়ে চলে যান। এবিটির জসীম উদ্দিন রাহমানির অবর্তমানে আব্দুল হাকিম তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। পরে তাকে জেএমবির ‘সারোয়ার-তামিম’ গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তিনি ওই গ্রুপের কর্মীদের মোটিভেট করে জিহাদের জন্য আত্মহুতি দিতে প্রস্তুত করতেন।
মো. সোহেল রানা ওরফে খাদেম ওরফে মোয়াজ্জিন ‘সারোয়ার-তামিম’ গ্রুপের মৃত আমির সারোয়ার জাহানের বিশ্বস্ত গুপ্তচর ছিলেন। ২০১৩ সালে তিনি জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট হন। ২০১৫ সালে ‘সারোয়ার-তামিম’ গ্রুপে যোগ দেন। তিনি ঝিনাইদহ শহরের একটি মসজিদের মোয়াজ্জিন। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে তার বাসস্থান ও কর্মস্থল ছিল ধর্মীয় উগ্রবাদপন্থীদের একটি ‘সেফ হাউস’। সেখানে মৃত সারোয়ার জাহান কুষ্টিয়া ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে গোপন বৈঠক করেছিলেন। সেই আলোচনায় একটি থানায় হামলার পরিকল্পনা করা হয়। থানা এলাকায় তথ্য সংগ্রহ করার দায়িত্ব দেয়া হয় শহীদুল্লাহকে।
শেখ মো. আবু সালেহ ওরফে লিটন ‘সারোয়ার-তামিম’ গ্রুপের প্রশিক্ষক ছিলেন। তিনি ২০০২ সালে মামুনের মাধ্যমে জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট হন। ২০০৩ সালে তিনি কারাত শেখার জন্য কিউকুশান কলাবাগান শাখায় ভর্তি হন, পরবর্তীতে ব্লাক বেল্ট পান। ২০০৬ সালে মাওলানা হাকিমের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। মাওলানা হাকিম তাকে গ্রুপের কারাতে প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দানের সুপারিশ করেন।
‘সারোয়ার-তামিম’ গ্রুপের আরেকজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন রাজীবুল ইসলাম ওরফে রাজীব। তিনি জেএমবির আধা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র চালানোর উপর বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং সারোয়ার-তামিম গ্রুপের একজন অস্ত্র প্রশিক্ষক। মূলত ২০০৭ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত জসীমউদ্দিন রাহমানির ঘনিষ্ট সহচর ছিলেন তিনি। মাওলানা হাকিমের মাধ্যমে ২০১৫ সালে তিনি গ্রুপে যোগদান করেন। অস্ত্র চালানোর বিষয়ে সিলেটে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। রাজীব ঢাকা কলেজ থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করেছেন। বর্তমানে ফাইভ স্টার সিমেন্ট কোম্পানির সেলস রিপ্রেজেনটেটিভ হিসেবে কর্মরত আছেন।
সম্পাদনা: সজিব ঘোষ