
বিশেষ প্রতিনিধি:
ঢাকা : স্বজন-সহকর্মীসহ সারা দেশের মানুষ সোচ্চার হওয়ার কারণেই এখনও বেঁচে আছেন, এমনটাই মনে করছেন উত্তরাঞ্চলীয় জেলা শহর কুড়িগ্রামের নির্যাতিত সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগান।
মুঠোফোনে নিউজনেক্সটবিডিকে তিনি বলেন, “স্বজন-সহকর্মী, সর্বোপরী সমগ্র বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। তারা সবাই যে যার জায়গা থেকে তাৎক্ষণিকভাবে পাশে দাঁড়িয়েছেন বলেই ‘আল্লাহ’ আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।”
মাদকবিরোধী টাস্কফোর্সের অভিযানের কথা বলে শুক্রবার মধ্যরাতে বাড়ির দরজা ভেঙ্গে সাংবাদিক রিগানকে আটক করা হয়। চোখ ও হাত বেঁধে তাঁকে মারতে মারতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়ে ‘এনকাউন্টারে’ হত্যার হুমকী দেওয়া হয়।
মারধরের পর ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয় অনলাইন গণমাধ্যম বাংলা ট্রিবিউন এবং ইংরেজী দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউনের এই জেলা প্রতিনিধিকে। ঘটনা তদন্ত করে সোমবারই কুড়িগ্রামের (ডিসি) সুলতানা পারভীনকে প্রত্যাহার করেছে সরকার।
এর আগে রোববার সিনিয়র সহকারী কমিশনার বা রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি) নাজিম উদ্দিন এবং সহকারী কমিশনার রিন্টু বিকাশ চাকমা ও এসএম রাহাতুল ইসলামকে সড়িয়ে নেওয়া হয়।
“সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর প্রতিও আমি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি,” নিউজনেক্সটবিডিকে বলেন রিগান।
জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন রোববার সাংবাদিকদের বলেন, “রংপুরের বিভাগীয় কমিশনারকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তদন্তের খসড়া প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। এতে দেখা গেছে এই ঘটনায় বেশ কিছু অনিয়ম হয়েছে।”
জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ারও আশ্বাস দেন মন্ত্রী।

ফৌজদারী আইনে বিচার দাবি : আইনগত সহায়তা প্রদানকারী মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক)সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন নিউজনেক্সটবিডিকে বলেন, “তাদের প্রচলিত ফৌজদারী আইনে বিচার হওয়া উচিত। শুধুমাত্র বিভাগীয় ব্যবস্থা নিয়ে, সরকারী কর্মকর্তাদের শাস্তিমূলক বদলী, বরখাস্ত বা চাকুরিচ্যুত করে এই ধরণের ঘটনা কমানো যাবে না।”
সদ্য বরখাস্ত হওয়া ওই ডিসি ও তাঁর অধীনস্ত কর্মকর্তাদের ভূমিকা দেশের নির্বাহী বিভাগকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে উল্লেখ করে এই মানবাধিকার কর্মী বলেন, “সেখানে রাতের বেলা দরজা ভেঙ্গে ঘরে প্রবেশ করার চেয়েও বড় অপরাধ হয়েছে সাংবাদিক রিগানকে ‘এনকাউন্টারে’ মেরে ফেলার হুমকী দেওয়া। এগুলো ফৌজদারী অপরাধ। অতএব সেই আইনেই তাদের বিচার হতে হবে।”
“যারা দেশ পরিচালনা করে সেই রাজনীতিবিদদের যদি ফৌজদারী আইনে বিচার হতে পারে, তবে এই রাষ্ট্রের যারা কর্মচারী, তাদের কেন হতে পারবে না?” যোগ করেন লিটন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্যের দায়ের করা মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার পরদিন ঢাকা থেকে সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হওয়ার তিনদিনের মাথায় কুড়িগ্রামে রিগানের সাথে এ ঘটনা ঘটে।
প্রতিবাদেই কারামুক্ত সাংবাদিক : গণমাধ্যম সূত্রে ঘটনাটি চাউড় হওয়ার পর বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাতে শুরু করেন। বিবৃতির পাশাপাশি নানা বিক্ষোভ কর্মসূচির মাধ্যমেও প্রতিবাদ জানায় সারাদেশের বিভিন্ন সাংবাদিক এবং সামাজিক সংগঠন।
তীব্র সমালোচনার মুখে রোববার দুপুরে রিগানকে জামিনে মুক্তি দেয় কুড়িগ্রামের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. সুজাউদ্দৌলা। তবে জামিন চেয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো আবেদন করা হয়নি বলে নিউজনেক্সটবিডিকে নিশ্চিত করেন আরিফুলের স্ত্রী মোস্তারিমা সরদার নিতু।

ডিসি সুলতানা পারভীন নিজেই কৌশলে রিগানের জামিনের ব্যবস্থা করেছেন বলে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে বাংলা ট্রিবিউন। অন্যদিকে রোববার সকালে রিগানের কারাদণ্ডের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে দায়ের করা এক রিটে আবেদনে মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ সংশ্লিষ্ট ১৭ জনকে বিবাদী করা হয়।
বাংলা ট্রিবিউনের নির্বাহী সম্পাদক হারুন উর রশীদের দায়ের করা ওই আবেদনে রিগানের আটক ও শাস্তি কেন সংবিধান পরিপন্থী নয় এবং কেন তাঁকে ৫০ লাখ টাকা কেন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারির আরজি জানানো হয়।
রিট আবেদনে ফৌজদারি কার্যবিধি, ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন, মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন এবং সংবিধানের ৩১,৩২,৩৫ এবং ৩৬ অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘনের কথাও তুলে ধরা হয়েছে, নিউজনেক্সটবিডিকে জানান সংশ্লিষ্ট আইনজীবী।
উচ্চ আদালতে নথি তলব : রিগানকে আটক এবং সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো সংক্রান্ত সব নথি তলব করেছেন উচ্চ আদালত। উল্লেখিত রিটের শুনানিতে বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও সরদার মো. রাশেদ জাহাঙ্গীরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ সোমবার এ আদেশ দেন।
রিট আবেদনের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেওয়া আইনজীবী এ এম আমিন উদ্দিন নিউজনেক্সটবিডিকে জানান, আগামী ২৩ মার্চের মধ্যে এসব নথি দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
“ওইদিনই মামলার পরবর্তী আদেশের দিন নির্ধারণ করা হয়েছে,” উল্লেখ করে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি আমিন আরো বলেন, “সেদিন ভিকটিমকেও (আক্রান্ত ব্যক্তি) হাজির রাখতে বলেছেন আদালত।”
নিজের প্রতিষ্ঠানের সাথে আলাপ করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানিয়েছেন রিগান। জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত সেদিন তাঁর বাসায় আধা বোতল মদ ও দেড়শ গ্রাম গাঁজা পেয়েছে দাবি করে সাজা দেয়। অভিযানে নেতৃত্বদানকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমার দাবি, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ, আনসার ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্স অভিযান চালায়।
“ভ্রাম্যমাণ আদালতের সামনে দোষ স্বীকার করায় রিগানকে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়,” স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছিলেন তিনি।
তবে আসকের সাবেক নির্বাহী লিটন বলেন, “মাদক বিরোধী অভিযানের যে চেহারা থাকে তার সাথে এই অভিযানে কোনো মিল নেই।”
নৃশংসতায় হতবাক রিগান : কুড়িগ্রাম শহরের চড়ুয়াপাড়ার নিজ বাড়ি থেকে মারতে মারতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় রিগানকে ‘এনকাউন্টারে’ মেরে ফেলার হুমকী দেন সিনিয়র সহকারী কমিশনার (রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর) নাজিম উদ্দিন।

“তিনি জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা, অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসাবে জেলা কারাগারের সুপারের কাজও সামলাচ্ছেন। আমি এটুকুই শুধু জানতাম। তবে তাঁর সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে কখনো পরিচয় বা আলাপ হয়নি। যে কারণে তিনি যখন নৃশংসভাবে ‘টর্চার’ করছিলেন, তখন আমি আসলে হতবাক হয়েই ভেবেছি- এটা কি করে সম্ভব,” নিউজনেক্সটবিডিকে বলেন রিগান।
মারতে মারতে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তুলেই চোখ-হাত-পা বেঁধে ফেলা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাকে বারবার বলছিলেন, তুই কলেমা পড়ে ফেল। তোকে এনকাউন্টার দেওয়া হবে।”
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, “এ ঘটনায় এটা আরো স্পষ্ট হয়ে গেল যে এই দেশে এনকাউন্টার, বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের যে নাটকগুলো সাজানো হয়, তাতে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোই নয়, প্রশাসনও জড়িত থাকে।”
“প্রতিটি ঘটনার পর যে নাটক সাজানো হয়, রাষ্ট্রের পক্ষে নির্বাহী হাকিমরাই তার আইনগত বৈধতা প্রদান করেন,” বলেন তিনি।
হাতে একটি ফাঁটল ধরা পড়েছে জানালেও রিগান নিউজনেক্সটবিডিকে জানান, তিনি আগের চেয়ে অনেকটাই সুস্থ।
ডিসির আত্মপক্ষ সমর্থন : প্রত্যাহার হওয়ার পর ডিসি সুলতানা সাংবাদিকদের এড়িয়ে চললেও মঙ্গলবার ফেসবুকে আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক বক্তব্য প্রকাশ করেছেন।
“অভিযান এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতের রায়ের প্রেক্ষিতে মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং এ বিষয়ে আমাকে দায়ী করে যে সংবাদ প্রকাশিত ও পরিবেশিত হচ্ছে তাতে আমি প্রচণ্ডভাবে মর্মাহত,” বলেন তিনি।
তাঁর দাবি, “অভিযান পরিচালনাকারী এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট অপেক্ষাকৃত অনেক নবীন ও যেহেতু আদালত কিছু বিধি-বিধান এবং পদ্ধতির মাধ্যমে পরিচালিত হয় সেহেতু উক্ত বিধি-বিধান এবং পদ্ধতি প্রয়োগে অনিচ্ছাকৃত ভুল হতেই পারে। সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আবেদনের প্রেক্ষিতে আপিল মঞ্জুর করে একদিন পর অর্থাৎ ১৫ মার্চ পূর্বাহ্ণে আরিফুল ইসলাম রিগানকে জামিন দেওয়া হয়।”
“নিয়মিত কার্যক্রমের আওতায় অভিযানটি পরিচালিত হয়, যাতে আমার সামান্যতম কোনও হস্তক্ষেপ ছিল না। কিন্তু আমাকে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে এবং হস্তক্ষেপের বিষয়টি উল্লেখ করে নিষ্ঠুরভাবে দোষী সাব্যস্ত করা হচ্ছে। অভিযান পরিচালনাকালে যদি সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট কোনও পদ্ধতিগত ভুল করেও থাকে, সেটির দায়ভার কি সরাসরি আমার ওপর বর্তায়?” যোগ করেন সুলতানা।
অন্যদিকে জামিনের পর রিগানের সাথে তাঁর কথোপকথনের একটি অডিও প্রকাশ করেছে বাংলা ট্রিবিউন। যেখানে তিনি বলেছেন, “এনকাউন্টারের মানসিকতা আসলে আমাদের ছিল না। তোমার মামলা প্রত্যাহার করে দেবো, সমস্যা নাই। একটু সময় দিও।”
তিনি রিগানকে গণমাধ্যমের সামনে মুখ না খোলারও পরামর্শ দেন ওই ফোনালাপে।