
অজিত সরকার, ঢাকা: চাঁন মিয়া হাওলাদার। গুলিস্তান বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামী লীগের অফিসের পাশে জুতা সেলাইয়ের (মুচি) কাজ করেন। ভয়াবহ ২১ আগস্টে শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড বোমা হামলার প্রত্যক্ষদর্শী তিনি।
বোমা হামলার পর আহত-নিহতদের গাড়িতে করে হাসপাতালে নেয়ার কাজেও সহযোগিতা করেছেন তিনি। সেদিন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে প্রয়াত মেয়র হানিফ বাঁচিয়েছেন বলে জানান চাঁন মিয়া।
তিনি বলেন, ‘আমি নিজ চোখে দেখেছি আমার পাশেই আওয়ামী লীগ নেতা কুদ্দুস পাটোয়ারীর এক হাত এক পা ছিঁড়ে গেছে। কয়েকজন পুলিশের হাত পাও ছিঁড়ে গেছে। ছাত্রলীগ নেতা রাসেলকে নিজে সেবাযত্ন করে বাঁচিয়েছি।’
২০০৪ সালে সারাদেশে জঙ্গিদের সিরিজ বোমা হামলা এবং গোপালগঞ্জে পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে ২১ আগষ্ট বিকেলে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের দলীয় কার্যালয়ের সামনে এক সমাবেশের আয়োজন করে।
ওই সমাবেশের প্রধান অতিথি ছিলেন শেখ হাসিনা। সেদিন প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছান বিকেল পাঁচটায়। একটি ট্রাকের ওপর তৈরি মঞ্চে তিনি কুড়ি মিনিটের বক্তৃতা শেষে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করার ঘোষণা দেন। হঠাৎ বিকট আওয়াজে একে একে ১১টি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়। এতে ঘটনাস্থলেই ১২ জন এবং পরে হাসপাতালে আরো ১২ জন নিহত হন।
মহিন উদ্দিন নামে এক হোটেল ব্যবসায়ী নিউজনেক্সটবিডি ডটকমকে বলেন, ‘আমি সেদিন বিকেলে হোটেল বন্ধ করে নেত্রীর ভাষণ শুনতে ঘটনাস্থলে আসি। হঠাৎ বোমার প্রচন্ড শব্দে এলোমেলো হয়ে যাই। পরে এসে দেখি রক্তের বন্যা। নিহত ও আহতদের গাড়িতে করে বিভিন্ন হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে।’
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী চা বিক্রেতা নূর মুহাম্মদ সরকার বলেন, ‘২১ আগস্টের দিন গ্রেনেড বোমার বিকট আওয়াজে লোকজনকে দিক-বিদিক ছুটাছুটি করতে দেখেছি। সেদিন ঘটনার একটু পাশেই চা বিক্রি করছিলাম। হঠাৎ লোকজনের ছুটাছুটিতে চায়ের কেটলির গরম পানি পড়ে আমার পা দু’টি ঝলসে যায়। সেদিন আমার দোকানের অনেক টাকার মালামাল ক্ষতি হয়।’
তিনি বলেন, ‘গ্রেনেড হামলার দিন ছেন্টু নামে এক আওয়ামী লীগ নেতা আমার দোকান থেকে চা খেয়ে বের হয়ে সমাবেশে আসতে না আসতেই বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন। চারদিকে শুধু কান্না আর কান্না, লাশ আর লাশ। সেদিন বিভিন্ন মিডিয়াতে নিহতের সংখ্যা ২৪ দেখালেও নিহতের সংখ্যা প্রায় ১০০ হবে। আহত হয়েছেন আরো কয়েকশ।’
আওয়ামী লীগ অফিসে আসা নেতাকর্মীদের বিভিন্ন কাজে সহায়তা করেন বাচ্চু মিয়া। তিনি বলেন, ‘গ্রেনেড হামলার দিন অনেক লাশ গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েছি। কারো হাত নেই, কারো পা নেই, কারো মাথার খুলি নেই এরকম অনেক দেখেছি। সেদিন অনেক কাজ করেছি কিন্তু পরে কেউ আর খোঁজখবর নেয়নি।’
১৯৯১ সাল থেকে পার্টি অফিসের সাথেই পান-সিগারেট বিক্রি করেন জাফর। তিনি বলেন, ‘সেদিন বোমার বিকট আওয়াজে দোকান ফেলে পালিয়েছি। পরে এসে আইভি রহমান সহ অনেককেই বোমার আঘাতে কাতরাতে দেখেছি। সমস্ত রাস্তা রক্তে লাল হয়ে গেছে সেদিন। পরে বিএনপির লোকজন পানি দিয়ে রক্ত ধুয়ে ফেলে।’
আওয়ামী লীগ অফিসের পাশেই জুতা সেলাইয়ের কাজ করেন পিন্টু দাশ। তিনিও সাক্ষী এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের। তিনি বলেন, ‘গ্রেনেড হামলার পর একদল লুটপাটে মেতেছিল, আরেক দল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখেছে। সেদিনের ঘটনা মনে হলে এখনো গা শিউরে উঠে।’
দীর্ঘ ৩৮ বছর ধরে আওয়ামী লীগ অফিসের পাশে কম্বলের ব্যবসা করেন মো. নূর নবী। ২১ আগস্টের ঘটনা নিয়ে তিনি বলেন, ‘নেত্রীর বক্তব্য তখন প্রায় শেষ পর্যায়ে এমন অবস্থায় বোমা বিস্ফোরণের আওয়াজ। সেদিন বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী সাধারণ মানুষের কাছ থেকে মোবাইল, ঘড়ি, টাকা ইত্যাদি ছিনতাই করেছে। সেদিন আমাকে কয়েকজন সন্ত্রাসী হুমকিও দিয়েছে।’
এই গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নারী নেত্রী আইভী রহমান সহ ২৪ জন নিহত হন। এবং তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা সহ প্রায় ৫০০ জন আহত হয়।
২১ আগস্টের সেই দুর্বিসহ গ্রেনেড বোমা হামলার ঘটনায় তৎকালীন মহাজোট সরকারের সাবেক উপমন্ত্রী ও বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম পিন্টু, হরকাতুল জিহাদ প্রধান মুফতি হান্নান ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর সহ ২২ জনকে আসামি করা হয়।
সম্পাদনা: সজিব ঘোষ