
নুরুল আকবর সবুজ, লন্ডন: বছর তিনেক আগে পেশাগত কারণে পূর্ব লন্ডনের আপ্টন পার্ক এলাকায় এক বাঙালী মালিকানাধীন বাড়িতে গিয়েছিলাম। যতটুকু মনে পরে তখন মাওলানা সাইদি‘র যুদ্ধপরাধ মামলার আপিলের শুনানি চলছিল। বাসায় ঢুকেই দেখি কয়েকজন বোরকা পরিহিত মহিলা বাড়িওয়ালির সাথে কথা বলছেন। আমি যাওয়ার সাথে সাথে বোরকা পরিহিত মহিলারা ভিতরের কক্ষে চলে গেলেন। ভদ্র মহিলার স্বামী ঘুমে থাকার কারণে আমার কাজের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী তিনি-ই দিলেন। কথা প্রসঙ্গে যখন জানলেন আমি বাংলাদেশি তখন তিনি হাসিনা সরকারের গোষ্ঠি উদ্ধার করতে শুরু করলেন। তিনি যা বললেন, তার সারমর্ম হলো সরকার বিশ্বের সেরা মাওলানাদের অন্যতম সাইদি’কে ফাঁসি দেয়ার চেষ্টা করছে। তাই তার মামলার জন্য তারা (বোরকা পরিহিত মহিলারা) চাঁদা তুলছেন। প্রত্যেক সপ্তাহে তারা এই চাঁদা সংগ্রহে বাড়ি বাড়ি যান। কথা প্রসঙ্গে জানতে চেয়েছিলাম, এসব টাকা পাঠান কিভাবে? তিনি উত্তরে বললেন, এখানে জামাতে’র নেতাদের হাতে টাকা দিলে তারা পাঠান। আমার হাতে আরো কিছু কাজ থাকায় আমি আর বেশী কিছু জানার চেষ্টা করিনি।
একই ভাবে লন্ডনের বাঙালী কমিউনিটির একজন সেলিব্রেটি মাওলানা বেশ কয়েকটি চ্যরিটি পরিচালনা করেন। বাংলাদেশের গরীব মানুষের জন্য তিনি টেলিভিশনে নিয়মিত অর্থ উত্তোলন করেন। ওনার অফিসে চাকুরী করতেন আমার এক বন্ধু। তার ভাষ্য অনুসারে, নানা কাজে চ্যরিটি উত্তোলন করলেও ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করেন একটি। অর্থ উত্তোলন করেন চ্যারিটির নামে সুনির্দিষ্ট কাজে এবং বাংলাদেশের সুনির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে। কিন্তু বাংলাদেশে অর্থ প্রেরণের ক্ষেত্রে যা করেন তার পুরোটাই বে-আইনী। তিনি চ্যারিটির প্রাতিষ্ঠানিক অর্থ নিজের নামে বাংলাদেশে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের নিকট প্রেরণ করেন। এই প্রক্রিয়ায় অর্থপ্রেরণ ব্রিটিশ আইনেও নিষিদ্ধ।
এভাবে অর্থ প্রেরণ ব্রিটিশ আইনে যেমন নিষিদ্ধ, তেমনি এ ধরণের চ্যারিটির অর্থগ্রহণ বাংলাদেশের আইনেও নিষিদ্ধ। যতটুকু জানি বিদেশ থেকে প্রেরিত কোন চ্যারিটির অর্থ বাংলাদেশের কোন প্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠানের কেউ গ্রহণ করতে হলে উক্ত প্রতিষ্ঠানকে এনজিও ব্যুরোর অনুমতি থাকতে হবে। শুধু অনুমতি থাকলেই চলবে না। প্রতিষ্ঠানকে গৃহীত অর্থে কি কাজ করা হয়েছে তার হিসাব প্রতি ছ’মাস অন্তর জমা দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এভাবে আইন ভেঙে চ্যারিটি’র অর্থ বাংলাদেশে যাওয়া সত্ত্বেও আইন শৃংখলা বাহিনীর লোকজন নাকি কোন প্রমান খুঁজে পান না। অথচ আইনের এ সহজ সূত্রধরে ব্রিটেনের চ্যারিটি কমিটির সাথে সরকারী পর্যায়ের যোগাযোগ লন্ডন ভিত্তিক জঙ্গি অর্থের লাগাম টেনে ধরা সহজতর হতে পারতো। এ খাতের সাথে সংশ্লিষ্ট তাদের ভাষ্য অনুসারে বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রণমূলক এনজিও ব্যবস্থা ভেঙে বরং স্বপ্রণোদিত হয়ে মসজিদ-মাদ্রাসাগুলোকে এনজিও অর্থ গ্রহণের সুযোগ দিয়ে অর্থের হিসাবটা নিয়ন্ত্রন রাখা যেত । জঙ্গিদের অর্থ উত্তোলনের মূল জায়গা কিন্তু বাংলাদেশী কমিউনিটি।
বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত সেলিব্রেটি ব্যারিস্টার পরিচালিত একটি চ্যরিটি জঙ্গি কাজে উদ্বোদ্ধ করেছে এ ধরণের একটি ডকুমেন্টারি প্রচারিত হওয়ার পর তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। যে বিল্ডিংটিতে এ চ্যারিটির অফিস ছিল, সেটি নিয়ে খোদ ব্রিটেশ সমাজেও নানারকম কথার প্রচলন আছে।
দান-খয়রাতের অর্থ প্রেরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের কিছু ইতিবাচক প্রচারনাও জঙ্গিদের কষ্টের কারণ হতে পারে বৈকি। কিন্তু সরকার কি করছে অথবা আদৌ কিছু করছে কি-না তা বাংলাদেশ সরকারই ভাল বলতে পারবে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো সরকার যদি শুধু হাই কমিশনের কিছু অফিসারের উপর নির্ভর করে এ সমস্যার সমাধান করতে চায়, তাহলে হয়তো ইতিবাচক কিছু না-ও আসতে পারে। এ কথা সরকারের হয়তো সবাই জানেন, ব্রিটিশ এমপি-মন্ত্রী বা আমলা এবং কর্মচারীদের নিকট স্থানীয়দের গুরুত্ব বিদেশী কুটনীতিকদের চেয়েও বেশী। ব্রিটিশ সমাজে একজন সাধারণ নাগরিক কোন কাজে রাজনীতিকের কাছে গেলে সেটার তাৎক্ষনিক সমাধানের জন্য যা যা করা দরকার তা-ই করেন। কিন্তু একই মন্ত্রী বা এমপি বা কর্মকর্তা হয়তো কোন কুটনীতিকদের চিঠির জবাব দিতে কয়েক দিন এমনকি কয়েক সপ্তাহও লাগাতে পারে। কারণ জবাবদিহিতা না করলে সামনের নির্বাচনে ভোটের ভবিষ্যৎ তিনি জানেন। কর্মকর্তারাও জানেন তাদের বিরুদ্ধে সাধারণের একটি যৌক্তিক চিঠি চাকুরী জীবনে বড় রকমের সমস্যা তৈরী করতে পারে। তাই বাংলাদেশ সরকারকেও এসব সমাধানে স্থানীয় বাংলাদেশীদের দিয়ে ইতিবাচক ফল পাওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
লেখক: ব্রিটেন প্রবাসী সাংবাদিক