
ময়ূখ ইসলাম, ঢাকা: “শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে কোচিংকে বৈধতা দেওয়া হলে শ্রেণিকক্ষে পঠনপাঠন সবকিছুই অর্থহীন হয়ে পড়বে। তখন শিক্ষকেরা ছুটবেন স্কুল-কলেজের বাইরে কোচিং করাতে, অভিভাবকেরা প্রাণপণ ব্যয় করে এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার বাজারে ছোটাছুটি করবেন” দীর্ঘ পাঁচ বছর ঘসা-মাজার পর তৈরি ৪৯টি ধারাসংবলিত শিক্ষা আইনের চূড়ান্ত খসড়া প্রনয়ণের পর এমন অভিমতই প্রকাশ করেছেন বিশিষ্টজনেরা।
বরাবরই সরকার এবং দেশের শিক্ষাবিদরা কোচিং ও প্রাইভেট টিউশনির বিরুদ্ধে কথা বলে আসছেন। কিন্তু চূড়ান্ত শিক্ষা আইনে কোচিং ও প্রাইভেট টিউশনির বিরুদ্ধে ‘কড়া’ অবস্থান থেকে সরে ‘ছায়া শিক্ষা’ হিসেবে কৌশলে এর বৈধতা দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন তারা।
ছায়া শিক্ষা’র নামে কোচিং ও প্রাইভেট টিউশনির বৈধতা দেওয়া এবং বিনা অনুমতিতে সহায়ক বই প্রকাশের বিষয়টিকে অনাকাঙ্খিত ও বৈষম্যমূলক বলে মনে করেন শিক্ষাবিদসহ বিশিষ্ট নাগরিকরা।
কোচিং নির্ভরশীলতা ও গাইড বই শিক্ষার্থীদের মনস্তাত্বিক বিকাশে নেতিবাচক হিসেবেই দেখছেন মনোবিজ্ঞানীরা। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট’র সহকারী অধ্যাপক আহমেদ হেলাল নিউজনেক্সটবিডি ডটকম’কে বলেন, এসবের ফলে শিক্ষার্থীদের চামচ দিয়ে শিক্ষা খাইয়ে দেয়ার মত অবস্থা হচ্ছে। খেলাধুলা সহ এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিস থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে।ফলে থাকের দক্ষতা কমে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, কোচিং নির্ভর শিক্ষা থেকে তাদের পরীক্ষার নম্বর বাড়ছে ঠিকই কিন্তু প্রকৃত বিকাশ হচ্ছে না। অতিরিক্ত কোচিং নির্ভরতা শিশুদের স্কুলের প্রতি অনিহা তৈরি করছে।
সম্প্রতি শিক্ষাবীদসহ দেশের ৩৪ জন বিশিষ্ট নাগরিকের স্বাক্ষরকৃত এক বিবৃতিতে বলা হয়, “শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে কোচিংকে বৈধতা দেওয়া হলে শ্রেণিকক্ষে পঠনপাঠন সবকিছুই অর্থহীন হয়ে পড়বে। তখন শিক্ষকেরা ছুটবেন স্কুল-কলেজের বাইরে কোচিং করাতে, অভিভাবকেরা প্রাণপণ ব্যয় করে এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার বাজারে ছোটাছুটি করবেন”
তারা বলেন, “জনগণের চূড়ান্ত মতামতের জন্য ওয়েবসাইটে প্রকাশিত অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রণীত চূড়ান্ত খসড়াতেও (এপ্রিল ২০১৬) এই বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত ছিলো না। এখন জনমতকে পাশ কাটিয়ে নতুন ধারাগুলো কী কারণে অন্তর্ভুক্ত করা হলো, তা বোধগম্য নয়।”
এদিকে চূড়ান্ত খসড়ায় নোট বা গাইড বই নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে, যদিও সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হওয়ার পর এই নামে বই বের হয় না। তবে এখন ‘সহায়ক পুস্তক’ প্রকাশের সুযোগ রাখা হয়েছে অনুমোদন ছাড়াই।
খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো প্রকাশক বা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি কেবল সহায়ক পুস্তক বা ডিজিটাল শিখন-শেখানো সামগ্রী প্রকাশ করতে পারবেন। কিন্তু কোনো ধরনের নোটবই, গাইড বই বা নকল মুদ্রণ, বাঁধাই, প্রকাশ ও বাজারজাত করা যাবে না।
এ বিষয়ে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “পাঠ্যপুস্তক থাকলে সহায়িকা বইয়ের প্রয়োজন হয় না। বাণিজ্যিক কারণে এমন আইন করা হচ্ছে।”
গত ১৭ ডিসেম্বর এক অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ দেশে নোট, গাইড ও কোচিং বলে কিছু রাখা হবে না উল্লেখ করে জানান, সকল স্কুলে ভালো শিক্ষক দেয়া সম্ভব না হওয়ায় শিক্ষা আইনে বাড়তি ক্লাস ও সহায়িকা রাখা হয়েছে।
খসড়ার অন্যান্য বিষয়
খসড়ায় তিনস্তরের শিক্ষা ব্যবস্থার কথা প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি আইনে রুপ নিলে সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসবে। এমনকি ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণে আনতে বেশকিছু বিষয় প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ‘ও’ লেভেল, ‘এ’ লেভেল বা সমপর্যায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলা, বাংলাদেশের অভ্যুদয়, বাংলাদেশ স্টাডিজ বাধ্যতামূলক করতে হবে।
ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল ও কিন্ডারগার্টেনসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠানকে সরকারের নিবন্ধন নিতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বেতন ও অন্যান্য ফি শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক অনুমোদন নিতে হবে। অমান্য করলে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা এক বছর কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে বলেও জানানো হয় খসড়ায়।
এছাড়া সরকারের অনুমতি ছাড়া কোনো ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা যাবে না বলেও জানানো হয়েছে খসড়ায়। আইন ভঙ্গ করলে তিন লাখ টাকা জরিমানা বা ছয় মাসের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। তবে প্রবাসী বাংলাদেশিরা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) শিক্ষাক্রম ও সংশ্লিষ্ট দেশের আইন অনুযায়ী প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বাংলাদেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে পারবে।
‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’ এর আলোকে ২০১১ সালে ‘শিক্ষা আইন’ প্রণয়নের উদ্যোগ নেয় সরকার। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিবকে (আইন ও অডিট) আহ্বায়ক করে শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির কয়েকজন সদস্যকে শিক্ষা আইনের খসড়া তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। কমিটি ২০১২ সালে খসড়া তৈরি করে। পরে সংযোজন-বিয়োজন শেষে ২০১৩ সালের ৫ আগস্ট জনমত যাচাইয়ের জন্য আইনের খসড়া মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। এনিয়ে পরবর্তিতে নানা বিতর্ক দেখা দিলে আইন প্রণয়নের কাজ থমকে থাকে। এত কিছুর পর আবার শিক্ষা আইন প্রনয়ণের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন শিক্ষাবীদ ও বিশিষ্টজনেরা বলেন, ‘শিক্ষায় অগ্রগতির বিষয়ে বর্তমান সরকারের বিভিন্ন ইতিবাচক উদ্যোগের পরও যদি এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়, তাহলে তা হবে শিক্ষাব্যবস্থার জন্য বিপর্যয়কর এবং শিক্ষানীতির মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এতে শিক্ষার মানোন্নয়নে সরকারের সদিচ্ছা প্রশ্নবিদ্ধ হবে, পারিবারিক পর্যায়ে শিক্ষার সামগ্রিক ব্যয় বৃদ্ধি পাবে, সর্বোপরি মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে।’
সম্পাদনা: রাকিব