‘সংগ্রামের যে কাহিনী শেষ হয়নি’

সায়েদ আশরাফ:
- ১:
১০ এপ্রিল, ১৯৭০ সাল। বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) মুক্তিপ্রাপ্ত এক চলচিত্রের প্রথম দিনেই সেটা নিয়ে তুমুল হৈচৈ শুরু হয়ে গেল। ছবিটি কোন প্রোপ্যাগান্ডা সার্ভ করার উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, এমনকি কোন রাজনৈতিক দলের প্রচারপত্র ছিল না। বরং বলা যায় সেটি ছিল একটি জাতির মুখপত্র। সেটাইবা পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী মেনে নেবে কেন? তাই ফলাফল হিসাবে যা হওয়ার তাই হলো, মুক্তির প্রথম দিনেই নিষিদ্ধ হলো সিনেমাটির প্রদর্শনী! কিন্তু যে চলচিত্রের বক্তব্য জনসাধারণের ভেতরকে নাড়া দিতে পেরেছিল, তাকে নিষিদ্ধ করার সামর্থ্য যে শাসকগোষ্ঠীর নেই।
‘একটি দেশ
একটি সংসার
একটি চাবির গোছা
একটি অন্দোলন’
সাধারণ একটা পরিবারের গল্প। কিন্তু এর আড়ালে বলা হয়ে যায় একটি জাতিকে দমন করে রাখার ইতিহাস। বলা হয় নিপীড়িত- শোষিত জনতার জেগে ওঠার কথা। চিত্রনাট্য থেকে শুরু করে সংলাপ, অভিনয়, সংগীত আর পরিচালনার অসাধারণত্বে এটি হয়ে ওঠে ক্লাসিক এক চলচ্চিত্র। কথা বলা হচ্ছে ‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমাটি নিয়ে। যার পটভূমি হিসাবে উঠে এসেছে ভাষা আন্দোলন এবং উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান।
‘জীবন থেকে নেয়া’র গল্প চলচ্চিত্র হিসাবে মুক্তি পায় ১৯৭০ সালে, কিন্তু প্রি-প্রডাকশনের কাজ শুরু হয়েছিল আরো বছর দুয়েক আগে থেকেই। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বেড়াজাল ধীরে ধীরে বেড়েই চলছিল। তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আর বাঙালীর ছাই চাপা ক্রোধকে জান্তা সরকারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সেলুলয়েডের পর্দায় তুলে আনার দুঃসাহসকে কোনভাবেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। বাকহীনতার সময়ে ছোট এক পরিবারের আড়ালে তৎকালীন অচলায়তনের মুখচ্ছবিকে গুরুত্ব না দিয়ে পারা যায় না।
বাবার বাড়িতে থাকা বড়বোনের দমন- পীড়নে অতিষ্ঠ সকলে। সেই বোনের আঁচলে দোলে চাবির গোছা। তার পেছন পেছনে গৃহপরিচিকা বয়ে নিয়ে বেড়ায় পানের বাঁটা। রুপক এই দৃশ্যের মাধ্যমে স্বৈরশাসকের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার বিভীষিকাকে কিভাবে উপেক্ষা করা সম্ভব! কিংবা ‘এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে’। ছবির কাহিনীতে কখনোই পুরো গানটুকু শোনা যায় না। কেননা খাঁচা ভাঙার সংগ্রামের যে কাহিনী শেষ হয়নি। যতদিন পর্যন্ত মানুষের মুক্তি পুরোপুরি অর্জিত হবে না ততদিন এই আকুতি এবং সংগ্রাম যে চলতেই থাকবে।
এই ছবিতে প্রভাত ফেরীর নির্মলতা কিংবা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানের উদ্দীপনাকে যে অগ্রাহ্য করা যায় না। কিংবা যদি ক্যামেরার কাজের কথা বিবেচনায় আনা হয় তাহলে মিছিলের সময় গুলির শব্দ এবং হাত থেকে প্ল্যাকার্ড পরে যাওয়ার মাধ্যমে মৃত্যুকে বোঝানোর প্রচেষ্টা প্রশংসা পাওয়ার দাবিদার। ব্যবহার করা হয়েছে ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের বেশ কিছু স্থির ছবি। সবমিলিয়ে পরিচালকের দক্ষতায় এক সাধারণ পরিবারের গল্প হয়ে দাঁড়ায় আমাদের জাতীয় মুক্তির আখ্যান।
- ২:
প্রথম দৃশ্য, নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দফতর। ফিটফাট হয়ে বসে থাকা ভদ্রলোকদের অন্যন্য সাধারণ সব কথাবার্তা।
দ্বিতীয় দৃশ্য, ভিয়েতনামের ধ্বংসযজ্ঞ, নারী-পুরুষ-শিশুদের গণহত্যা। সাথে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের যুদ্ধপরাধী এক লেফট্যান্টের পক্ষে সাফাই।
তৃতীয় দৃশ্য, বুড়িগঙ্গার তীর, গ্রাম-জনপদ। ভেসে উঠে লাশ। সামনে-পেছেনে, ডানে-বামে লাশের স্তূপ। গলিত লাশ। বুলেটবিদ্ধ লাশ। চোখ উপড়ানো, মাথার খুলি উপড়ানো এবং মগজ বেরিয়ে যাওয়া লাশ।
১৮ মিনিট। মাত্র ১৮ মিনিটের একটি ডকুমেন্টারি ‘স্টপ জেনোসাইড’। যা কিনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল মানবাধিকারের নামে যে বাহস চলছে তারই আড়ালে খেলা করছে বিচিত্র সকল পরিহাস! একইসাথে বিশ্বব্যাপী পাকিস্তানীদের প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বিশ্বের কাছে জানিয়ে দেয় বাঙালীদের প্রতি অবিচারের কথা, নিরীহ বাঙালীদের উপরে গণহত্যার সেই সব কথাগুলো। হাজার বছর ধরে তৃষ্ণা’ত শেষ বিকালের মেয়ে’টিকে আরেক ফাল্গুন’এর স্বপ্ন দেখানো লোকটিকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
শুভ জন্মদিন জহির রায়হান।
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী
নিউজনেক্সটবিডি ডটকম/তুসা