Tuesday, September 26th, 2023
সহমর্মিতার জয় হোক
March 30th, 2020 at 6:46 pm
সহমর্মিতার জয় হোক

প্রিয় বন্ধু,

কেমন আছো তুমি,কেমন আছে আমার দেশ? আমেরিকায় আমরা যত খারাপই থাকি না কেন আমাদের মনে থাকে বাাংলদেশে। বিশেষ করে আমার তো সবই বাংলাদেশে।         

প্রিয় বন্ধু, আমরা পুরো বিশ্ব একসাথে একটি মহামারীর কাল অতিক্রম করছি, আমরা এক একটি দেশ নিজের নিজের মত করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছি। গত তিন দিন থেকে পুরো দুনিয়া আমেরিকার দিকে তাকিয়ে আছে, কারণ হল তিন দিন পূর্বে আমেরিকা হয়ে গেছে সংখ্যার দিক থেকে নাম্বার ওয়ান আক্রান্ত দেশ, আর আমেরিকার ভিতরে নিউ ইয়র্কে আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।

গত চিঠিতে তোমাকে লিখেছিলাম আমেরিকার করোনা রুগীর সংখ্যা বাড়ছে, গত সপ্তাহের হিসাবে আমেরিকায় মোট ১৯,৪৫৯ জন আক্রান্ত হয়েছিল আর মারা গিয়েছিল ২৬৩ জন।এক সপ্তাহ পরে আজ আক্রান্ত রুগীর সংখ্যা ১৩৩,১৪৬ জন মারা গিয়েছে ২৩৬৩ জন। নিউ ইয়র্কের রুগী সংখ্যা ছিল ৮,৫১৬ জন মারা গিয়েছিল ৫৩ জন। আজকের সকালের হিসাবে আক্রান্ত রুগীর সংখ্যা ৫৯,৫১৩ আর মারা গিয়েছে ৯৬৫ জন। আজকের নাম্বার এর দিকে যদি দেখি তবে ভয়ের বিষয় হল আমেরিকায় এখন সবচে বেশী মানুষ আক্রান্ত বিশেষ করে নিউ ইয়র্কের আক্রান্ত রুগীর সংখ্যা আমাদের ভয় এর কারণ তো হতেই পারে।

বন্ধু, নাম্বারের মধ্যে একটা আশাও আছে,গত সপ্তাহের চিঠিতে তোমাকে লিখেছিলাম আক্রান্ত রুগীদের মধ্যে আমেরিকায় কেউ সেরে উঠেনি! আজ যখন তোমাকে লিখছি পুরো আমেরিকায় সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছে ৪,৩৭৮ জন তার মধ্যে নিউ ইয়র্কে ৩,৫৭২ জন। বন্ধু, সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে শুধু একটি নিউজ ঘুরে ফিরে দেখছি প্রতি সাড়ে নয় মিনিটে নিউ ইয়র্কে একজন মারা যাচ্ছে! কেউ বলছে না কতজন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছে। নিউ ইয়র্কের গভর্নরের ডাকে সাড়া দিয়ে চল্লিশ হাজার অবসর প্রাপ্ত ডাক্তার-নার্স স্বেচ্ছাসেবা দিতে তৈরি হয়ে গেছে, আট হাজার পাঁচশত অবসর প্রাপ্ত অভিজ্ঞ মেন্টাল হেলথ স্পেশালিস্ট সাইন করেছে মানুষ কে অনকল সার্ভিসের মাধ্যমে সেবা দিতে।

আমরা যখন নাম্বার দেখব এই সকল নাম্বারও ইম্পরট্যান্ট, আমাদের গভর্নর মেয়র বলে দিয়েছে নিউ ইয়র্কের অর্ধেক লোক আক্রান্ত হবে। আমাদের কেউ মিথ্যা সান্ত্বনা দিচ্ছে না, প্রতিদিন গভর্নর মেয়র সকাল দুপুরে আক্রান্ত রুগীর নাম্বার তাদের প্রশাসনিক অক্ষমতা আর বাস্তব চিত্র নিয়ে হাজির হয়।

আমরা জানি আমাদের হসপিটালে সাপ্লাই শেষ হয়ে যাচ্ছে, ভেন্টিলেটর অনেক কম,,ডাক্তারদের সুরক্ষা পোশাক যথেষ্ট নাই, ফেডারেল গভর্মেন্ট আমাদের কে পর্যাপ্ত পরিমাণ জিনিসপত্র দিচ্ছেনা। গতকাল দেখলাম জেকবি হসপিটালের নার্সরা প্ল্যাকার্ড হাতে বাইরে এসে নিরাপত্তা ইকুইপমেন্ট এর জন্য আন্দোলন করছে কিন্তু তারপরেও তারা নিজেদের জীবন বিপন্ন করে সেবা দিয়ে যাচ্ছে।

আমাদের সকলের মৃত্যু ভয় আছে, থাকবে সেটাই স্বাভাবিক,আমরা যখন শুনি নিউ ইয়র্কে একজন মারা গেলে বিছানা খালি হলে আরেকজন কে ভর্তি করে; ভীষণ কষ্ট হয়। আমি সারাদিন ২০ থেকে ২৫টা কল রিসিভ করি তাদের অনেকেই ভয়ে আছে অনেকের আত্মীয় স্বজন আক্রান্ত,আমারও আত্মীয় স্বজন বন্ধু চেনা জানা অনেকেই আক্রান্ত কেউ কেউ মারা গেছে। আমার বিল্ডিং থেকেও আক্রান্ত রুগী হসপিটালে গেছে, অনেক ভয় পাওয়া মানুষ যাকে কল করে ভরসা পাওয়ার জন্য তার বোধহয় ভয় থাকলে, কষ্ট পেয়ে বসে থাকলে চলে না।

বন্ধু, আমার শরীর ভাল না আমার যদি করনা হয় আমিও হয়তো বাচঁব না, আমি মরে গেলেও আফসোস নাই কারণ মৃত্যু তো একদিন আসবেই শান্তিতে যাব এই ভেবে – আমাদের ডাক্তার নার্স মেয়র গভর্নর জনগণ কেউ চেষ্টা কম করেনি। মানবতার কত ভয়াবহ আর সুন্দর রূপ হতে পারে কভিড নামক মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী ডাক্তার নার্স রা তাদের জীবন দিয়ে আমাদের দেখিয়ে গেল। বন্ধু, কভিড বীরের সংজ্ঞা বদলে দিয়েছে তাইতো আজ সামাজিক মাধ্যমে চায়না,ইতালি আমেরিকা,ইরান,ইংল্যান্ড,ইন্দোনেশিয়ার ডাক্তার নার্সদের বীরত্বের কথা শুনতে পাচ্ছি।

বন্ধু, বিশ্বের যে কুনো বড় দেশের দিকে তাকাও তাদের পাবলিক হেলথ যে কত নড়বরে তা বুঝা যায়,আমেরিকা ইতালি ফ্রান্স ইংল্যান্ড স্পেন কেউ এই পরিস্থিতির জন্য তৈরি ছিল না সেটা মেনে নিলাম, কিন্তু যখন তাদের দেশ আক্রান্ত হল তখনও ধীর নীতি তাদের ডুবিয়েছে আর আমাদের তো কপাল আরও খারাপ – ট্রাম্প নামক জোকারের সময়জ্ঞান তো বলতে গেলেই নাই।

আমরা নিউ ইয়র্কবাসী মরে গেলে তার কিছুই আসে যায় না! সে আছে তার ইকোনমি নিয়ে,কত ট্রিলিয়ন ডলার বিল পাশ করবে আর কর্পোরেশন এর ক্ষতি পুষিয়ে দিবে, নিজের হোটেল খাতে কত পাবে সেই নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের সাপ্তাহিক গুলি বড় করে লিখে ট্যাক্স পে জনগণ কত ডলার পাবে সেই বিল থেকে, আর আবাল জনতা সেই হিসাব নিয়ে ব্যস্ত থাকে। জনগণ জানতেও পারে না এই ডলার পরের বছর থেকে আবার ফেরত দিতে হবে,আমাকে কল করে সবাই যখন জানতে চায় কত পাব আমি বলি দোয়া করি বেঁচে-সুস্থ থাকেন টাকা যা পাবেন ব্যাংক এ আসবে ওইটা নিয়ে ভাবতে হবে না।

অনেকেই আশার আলো খুঁজে পায়, কারণ গভর্নর অনেক অস্থায়ী হসপিটাল বানাচ্ছে কিন্তু ভেন্টিলেটর ইকুইপমেন্ট কোঁথা থেকে আসবে সেই চিন্তাও করতে হবে। আজ ইতালির পাশে সারা দুনিয়া দাড়িয়ে গেছে তবু ইতালির মৃত্যুর হার দৈনিক হাজারের কাছে, স্পেনও একই অবস্থা; আমাদের কি হবে জানি না শুধু জানি আমাদের বেঁচে থাকার লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে।

বন্ধু, লড়াই শুনে খটকা লাগছে! হা লড়াই-ই তো! নিজেকে ঘরে বন্ধী রাখার লড়াই! সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করার লড়াই! আমাদের নিরাপত্তা সামগ্রী পাওয়ার জন্য প্রশাসনিক চাপ তৈরীর লড়াই! শারীরিক ভাবে একে অপরের পাশে না থেকেও পাশে অনুভব করার লড়াই। পরিস্থতি যাই হউক জয়ী আমাদের হতেই হবে; এতগুলি ডাক্তার নার্স নিজের জীবন বিপন্ন করছে আমাদের জন্য – আমরা তাদের হেরে যেতে দিব না।

বন্ধু, বাংলাদেশে আর বাংলাদেশীদের কি হয়েছে? সারা বিশ্বে যেখানে রাজা, রাজকন্যা, প্রধানমন্ত্রী কেউ বাদ যাচ্ছেনা করোনার ছোবল থেকে সেখানে বাংলাদেশ থেমে আছে! একি ভয়ংকর কোনো সর্বনাশের পূর্বাবাস? বাংলাদেশ হয়ত টেস্ট ই করছে নয়া, “টেস্ট নাই করোনা ও নাই।“ গতকাল দেখলাম আকিজ গ্রুপের উদ্যোগে একটি হসপিটাল হচ্ছিল সেখানেও চাঁদা না দেওয়ার জন্য ভাংচুর! সারাদেশ থেকে খবর করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তির জানাজা ছাড়া দাফন, উপসর্গ দেখা দেওয়া ব্যক্তির চিকিৎসা করবে না ডাক্তার, কবরস্হানে সাইন এখানে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির দাফন হবে না! বিদেশ ফেরত মানুষজন নিকট আত্মীয় গ্রামের মানুষ দ্বারা হয়রানির শিকার! পুলিশ প্রশাসন খেঁটে খাওয়া সাধারণ মানুষদের লক-ডাউন এর নামে শারীরিক অত্যাচার করছে। আমার মনে হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের মানুষের মানবিক গুনাবলি শেষ হয়ে গেছে তারা অধম হয়ে গেছে – নইলে বিশ্ব পরিস্থিতি দেখেও তাদের মনে ভয় তৈরি হয়নি কেন?

বন্ধু, শেষ করার পূর্বে একটি ঘটনা বলি, আমাদের শহরে একটি হসপিটাল আছে এলমার্স্ট হসপিটাল যেখানে করোনা টেস্ট চিকিৎসা দেওয়া হয়,দৈনিক ১৩ জন রুগী ঐ হসপিটালে মারা যাচ্ছে। হসপিটালের বাইরে ২ টি তাবু টানিয়ে লাশ ঘর বানানো হয়েছে যেখান থেকে কিছুক্ষণ পর এসে সিটির লোকজন লাশ সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছে। এই ঘটনায় এলাকাবাসী খুব ই আতংকিত তারপরেও তারা হসপিটালের উল্টা পাশের পার্কের দেয়ালে বিশাল বড় “থাঙ্ক ইউ” লিখে রেখেছে – ঐ হসপিটালে কাজ করা ডাক্তার নার্স কর্মচারীদের জন্য। আমি এলমার্স্ট এর বাসিন্দাদের বলব মানুষ পূর্ণ মানুষ যারা নিজেদের ভয় থেকেও মানবিকতাকে বড় করে দেখেছে।

ভাল থাক বন্ধু ভাল থাকুক আমার দেশ ও দেশের মানুষেরা।

ইতি

তোমার বন্ধু যাকে কোনো নামেই ডাকোনা

লেখক: মানবাধিকার কর্মী

সর্বশেষ

আরও খবর

নিউ ইয়র্কের চিঠি- ৩৭

নিউ ইয়র্কের চিঠি- ৩৭


মানবিক হও!

মানবিক হও!


মহামারীর এই সময়ে মানুষের পাশে থাকুন

মহামারীর এই সময়ে মানুষের পাশে থাকুন


আসছে শুভদিন!

আসছে শুভদিন!


আমাদের ঝালমুড়ি দাদা ও গরীবের শ্রেণী সংগ্রাম

আমাদের ঝালমুড়ি দাদা ও গরীবের শ্রেণী সংগ্রাম


জন্মভূমির টান মানসিক কষ্টে ফেলে দেয়

জন্মভূমির টান মানসিক কষ্টে ফেলে দেয়


‘মুসলিম সমাজের বিভাজন বন্ধ করুন’

‘মুসলিম সমাজের বিভাজন বন্ধ করুন’


আজ জুইস-মুসলিম এক কাতারে দাঁড়িয়েছে

আজ জুইস-মুসলিম এক কাতারে দাঁড়িয়েছে


সর্ব পর্যায়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে

সর্ব পর্যায়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে


ভাবতেই কষ্ট হয় আমিও বাঙালি

ভাবতেই কষ্ট হয় আমিও বাঙালি