
প্রিয় বন্ধু,
কেমন আছ, আশা করি ভাল আছ। মজার একটা কথা বলি শোন, তোমার কাছে লেখা চিঠি একটা অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, সেটাতো জান। অনেকেই আমার ফেইসবুকে ম্যাসেজ দিয়ে জানতে চায় তুমি কে? এক সাংবাদিক বন্ধু একটা ম্যাসেজ দিয়েছে। একটু অন্যরকম, সরাসরি উঠিয়ে দিলাম এখানে, “ভালো লাগলো চিঠিটা। তবে খটকা লাগলো, বন্ধুকে চিঠি লিখছো, অথচ সেই সেই বন্ধু তোমাকে কোন নামেই ডাকে না, তা দুঃখজনক। আমি তোমাকে একটা নাম দেই—ঈগলকন্যা। হ্যাঁ, আমার মনে হয় এটাই যথার্থ হবে। কারণ তোমার অনুসন্ধানী চোখ সব সময় মানবতার পক্ষে যুক্তি খোঁজে, আক্রান্ত মানুষের পক্ষে কথা বলতে সাহায্য করে। যদিও তুমি তা তোমার পেশাগত দায়িত্ব মনে করো। কিন্তু আমি ভাবছি, তুমি শুধু মানবতাবাদীই নও, সে সাথে প্রেমিক মন নিয়ে আমাদের বিবেক জাগ্রত করতে তোমার লেখার মাঝে বন্দী করছো। তোমাকে অভিবাদন বন্ধু, ভালো থেকো”।
আমি লেখক হতে চাই না বন্ধু। লিখতে কষ্ট হয়, কারণ সময় স্বল্পতা। তবু রাত জেগে লিখি, ট্রেনে বসে লিখি, এয়ারপোর্টে বসে লিখি। শুধু মানুষকে স্বপ্নের দেশের সত্যিকারের চেহারাটা দেখাতে।
দিনটা ছিল শনিবার। আমার এক বন্ধুর আইফোন চেঞ্জ করতে অ্যাপল এর শপে গিয়েছিলাম। আজব এক শপ, যখনই যাই না কেন, যে কোনো কাজ হউক না কেন, নতুন কিনি বা পুরাতন ঠিক করি, ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা লাগবেই। অ্যাপল বলে কথা! আমার দুই বান্ধবী ছিল সাথে। ওরা বলল, চল সেন্ট্রাল পার্কে ঘুরি। আমি বললাম চলেন যাই। নগরীর প্রাণ কেন্দ্রে এত বড় পার্ক টিকে আছে বহু বছর, এই দেশে প্রকৃতিকে টিকিয়ে রাখতে যথেষ্ট সচেতন যদিও এরা অন্যের প্রকৃতি ধ্বংস করার রাজা। সেন্ট্রাল পার্কে গিয়ে একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল—যা এই দেশের প্রগ্রেসিভ মুভমেন্ট এ বহুল আলোচিত। এ বিষয় নিয়ে লিখব পরের চিঠি।
আজ কথা বলব সবচে’ আলোচিত বিষয় “আমেরিকার নির্বাচন” নিয়ে।
৮ নভেম্বরের নির্বাচন শুধু আমেরিকা নয়, সারা বিশ্ব তাকিয়ে ছিলো নির্বাচনের ফলাফলের দিকে। এবারের মত এত আলোচিত প্রার্থী আর ছিল কিনা আমেরিকার ইতিহাসে আমার জানা নেই। আমি বলছি ট্রাম্প এর কথা। রোজ মিডিয়াতে নতুন কিছু নিয়ে আলোচিত ব্যক্তি আর আর হিলারিও কম নয়। ইমেইল কেলেঙ্কারি তো আছেই, তাকেও কিছু না কিছুর মোকাবিলা সবসময় করতে হচ্ছে। গত কয়েকদিন ধরে ফেইসবুকে বসলেই চারদিক থেকে ম্যাসেজ প্লিজ ভোট ফর হিলারি বা সাপোর্ট হিলারি। বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য অনুরোধ। আমি বুঝে পাই না বাংলাদেশের মানুষের কী আসে যায় হিলারি পাশ বা ফেল করলে। বিএনপির লোকজন ভাবছে হিলারি আসলে তাদের ফায়দা; আওয়ামী লোকজন ভাবছে ট্রাম্প আসলে তাদের! বরিশালে একটি প্রবচন আছে- “ঘর পোড়ার মাঝে আলু পুড়ে খাইও না’ অর্থাৎ ঘর পুড়ছে একজনের, সেখানে আলু পুড়িয়ে খাওয়ার সুখ নিচ্ছে অন্যজন। এটা বাদ দিয়ে দুঃখ করার ডাক দেয়া হয়েছে।
হিলারি বাংলাদেশে বঙ্গোপসাগরে আমেরিকার আর্মি বেইজ বানাতে চান আর ট্রাম্প বলছেন সব গারমেন্ট শিল্প আমেরিকায় ফেরত আনবে। তার মানে বাংলাদেশের হাতে আমেরিকার গারমেন্টস এর অর্ডার থাকবে না। চারিদিক দেখে মনে হয় বাংলাদেশের মানুষ এর অবস্থা পাগলের সুখ মনে মনে। বন্ধু, আমার কথা শুনে আমাকে ট্রাম্প সাপোর্টার বলে ধরে নিও না; আমি ইলেকশন পাওয়ারে ভরসা রাখি না; যে আসে তাকেই মোকাবিলা করতে হবে আমাদের।
আমার অনেক মেম্বার লিডার সমাজের বাসিন্দা ভাই বোনেরা জানতে চেয়েছিলো—ট্রাম্প আসলে কী হবে? সবার মধ্যে উৎকণ্ঠা কাজ করছে। সবার মনে ভয়—ট্রাম্প আসলে মুসলিম ইমিগ্রেন্ট সবাইকে তাড়িয়ে দিবে। অনেক মানুষ যারা কাগজ পত্রবিহীন এই দেশে আছে শুধু একটা প্রশ্ন করে, আপা আমাদের কী হবে! আমাদের অনেক বছরের গ্যাপ বাংলাদেশের সাথে আমরা ওখানে গিয়ে কী করব?
আমি বলি, কত প্রেসিডেন্ট তো দেখলেন রিগ্যান, বুশ, ক্লিনটন, ওবামা—কেউ কি কারো চেয়ে কম ছিলেন? বুশ আর রিগ্যান তো বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ ও রাশিয়ার সাথে স্নায়ু যুদ্ধের জন্য বিখ্যাত। ক্লিনটনের আমলে ইমিগ্রেশন এর বিরুদ্ধে আইন পাশ করে ঘরে ঘরে তল্লাশি চালিয়ে মানুষকে গ্রেপ্তার করে ফেরত পাঠানোর অর্ডার জারি করেছিলেন। সে সময় ৬ মিলিয়ন মানুষ রাস্তায় নেমেছিল ইমগ্রেশনের দাবীতে। প্রেসিডেন্ট ওবামা সেই ইমিগ্রেশন বিরোধি আইনকে কাজে লাগিয়ে অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে ইতিহাসের সবচে বেশী কাগজপত্রবিহীন নাগরিকদের বহিস্কার করেছে। অথচ মানুষ ওবামাকে ক্ষমতায় আনার জন্য কাগজপত্রবিহীন নাগরিকেরা প্রচারণায় নেমেছিল, রোজা রেখেছে, হজ্জ মানত করেছিল। ওবামার বিরুদ্ধে সবচে বেশী অভিযোগ ছিল তিনি ক্ষমতায় আসার আগে ল্যাটিন ভোটারদের ইমিগ্রেশন এর বিষয়ে ওয়াদা করে বলেছিল “ইয়েস উই ক্যান” ক্ষমতায় আসার পরে গত ৮ বছরে তা করেনি। আমি সকল মেম্বার সমাজের মানুষের উৎকণ্ঠার জবাবে একটাই প্রশ্ন করি, এই লোকটা সবাইকে হুমকি দিচ্ছে পাওয়ারে গেলে কী করবে, আর অন্য প্রেসিডেন্ট সেটা করেছে, তফাৎ শুধু একটাই তারা বলেনি এই লোক বলছে।
নির্বাচনের দিন। চারদিকে জীবন যেমন ছিল তেমনি আছে। কোনো সরকারি ছুটি নেই; সকাল ৬টা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ। মানুষ কাজে যাওয়ার পূর্বে বা কাজ থেকে ফেরার পরে ভোট দেয়। সামাজিক মাধ্যম বা টিভি চ্যানেল না খুললে বোঝার উপায় নেই ইলেকশন চলছে। সকালে আল জাজিরার একটি খবর চোখে পড়ে গেল—৫.৩৫ মিলিয়ন মানুষ ভোট দিতে পারবে না। কারণ তারা জেলে আছে বা তাদের অপরাধী হওয়ার কারণে ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
এবার বুঝেছ বন্ধু, আমাদের চোখে মহান আমেরিকার মহত্ব! দিন গড়িয়ে রাত নেমে আসলো, আমার কাছে ফোন আসার পরিমান বেড়ে গেল, সবার শুধু একটাই প্রশ্ন কী হচ্ছে আপা? আমি বললাম অপেক্ষা করেন ফ্লোরিডার ভোট আসুক দেখা যাক কী হয়। রাত ৭ তার পরে খবর আসল ফ্লোরিডা রিপাবলিকানদের হয়ে গেছে। আমি দ্রুত পোল দেখতে শুরু করলাম, হায় হায় অবস্থা চারিদিকে। সবাই ফেইসবুকে লিখছে “আই হেইট ফ্লোরিডা”—টিভির লাইভ পোল এ ট্রাম্প সাপোর্টারদের বর্ণবাদী মন্তব্য পাগলের মত অবস্থা। ভাবলাম ঘরে ফিরে যাই। কিছুই ভাল লাগছে না।
বাসায় ফিরে আবার লিখতে বসলাম। এত বেশী ফোন কল আসছিল কী লিখব? কী লিখব না! শুধুই প্রশ্ন সত্যি ট্রাম্প আসবে আমি সামাজিক মাধ্যমে সমাজকর্মী ও রাজনীতিবিদের মন্তব্য ফলো করছিলাম—“কেউ লিখছে হোপ হারবে না”, “কেউ লিখছে ফাক আমেরিকা”, “শিট আমেরিকা” আরও কত কী! নিজেদের ইমোশনকে বাইরে আনতে সবাই যার যার মত রাগ প্রকাশ করছিল।
রাত ১০টায় দেখলাম সিটি কাউন্সিল মেম্বার ব্রাড লেন্ডার লিখেছেন “শোক নয়, সংগঠিত কর নিজেকে।”—বুঝে গেলাম সব শেষ। মেম্বাররা কল করে কথা বলতে থাকল। রাত ৩.৩০টায় সব কিছু সাইডে রেখে ঘুমাতে গেলাম। ঘুম না বাকি রাত দুঃস্বপ্নে কাটল। সকালে তোমার কলে ঘুম ভাঙ্গল। আলোচনা করলাম কী হতে পারে বা না পারে এই সব নিয়ে। সামাজিক মাধ্যমে অনেকে লিখছে আমেরিকার যুদ্ধ নীতি সাধারণ আমেরিকান পছন্দ করেনি তাই ব্যালটে জবাব দিয়েছে, রিয়েলি!! যখন এই লোক খোলাখুলি বলছেন, তিনি মুসলিম-রিফুজি সবাইকে বের করে দেবেন। আমার মতে সাধারণ গরীব সাদা আমেরিকান ব্যালট এর মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থপরতার প্রমাণ করেছে। ক্লিনটন আমলে যে সোশ্যাল বাজেট কাট করেছে তার জবাব দিয়েছে—মানে হল যুদ্ধ কর লুট কর আমাদের হাউজিং ফুড স্ট্যাম্প হেলথ ঠিক রাখ। আরেকটি কথা না বললেই নয়, কালোদের বিরুদ্ধে “কেকেকে” গ্রুপ আবার সংগঠিত হচ্ছে। তারা সাদা স্টেটগুলিতে কাজ করেছে নিজেদের সংগঠিত করেছে। হিলারিকে ব্লাক লাইভ মেটার প্রগ্রেসিভ গ্রুপ ফেমিনিস্ট গ্রুপ পুরা সাপোর্ট দেইনি, এটা এই সময়ের সর্বসেরা ভুল, অনেকের মন্তব্য আমরা মনে করেছি সি ইস নট আওয়ার বেস্ট চয়েজ বাট উই ডিড মিস্টেক, তারা সংগঠিত হয়েছে; আমরা না।
যাই হউক বন্ধু কোনেদিন একপক্ষের খারাপ বলে কিছু নেই। তারা আঘাত করলে আমরা ফেরতে চেষ্টা করব, নিজেদের সংগঠিত করব। হয়ত আমেরিকা আজ নিজের ঘরে আগুন দিয়ে আলু পুড়ে খাওয়ার স্বপ্নে বিভোর। তার ঘরে আজ এমন প্রেসিডেন্ট যার কোনো ক্যপাসিটি নাই দেশ চালানোর। রিপাবলিকান হয়ত লবিং শুরু করবে তাকে লোক দিয়ে সাহায্য করার, তাদের সুপারিশ হয়তো তেমন ভাল হবে না, সেটাই বড় চিন্তা আমাদের। আমাদের সাইডে সকল গ্রুপ যারা তার পলিসিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে তাদের ঐক্য গড়তে হবে। আমাদের পরিকল্পনা করার সময় শুরু হয়ে গেছে। ২১ জানুয়ারি ক্ষমতা হস্তান্তর, তার আগে খুব খারাপ কিছু হবে না আর; তার আগেই আমাদের প্লানিং এর সময় শুরু হয়ে যাবে।
ভাল থাক বন্ধু। ভাল থাকুক দেশ ও দেশের মানুষেরা।
ইতি
তোমার বন্ধু যাকে তুমি কোনো নামেই ডাকোনা
লেখক: মানবাধিকারকর্মী