Wednesday, September 27th, 2023
সামরিক ডাইজেষ্ট: আকাশে উড়ছে কমব্যাট ঘাস ফড়িং
December 21st, 2020 at 9:41 pm
কম্বোডিয়ায় একজন শান্তিরক্ষীর অনবদ্য অ্যাডভেঞ্চার
সামরিক ডাইজেষ্ট: আকাশে উড়ছে কমব্যাট ঘাস ফড়িং


ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ বায়েজিদ সরোয়ার, এনডিসি (অবঃ);

বর্তমানে (১৯৯২) কম্বোডিয়ায় শান্তিপ্রতিষ্ঠায় কাজ করছে বত্রিশটি দেশের প্রায় ষোল হাজার শান্তিসেনা । শান্তিরক্ষীদের অন্যতম বাংলাদেশ দলের শান্তিসেনা আমরা। এই মিশনের নাম আনটাক (ইউনাইটেড নেশান্স ট্রানজিশনাল অথরিটি ইন কম্বোডিয়া)।বিশ্ববিখ্যাত মন্দির এ্যংকর ওয়াটের শহর সিয়ামরিপ থেকে বদলি হয়ে এখন আমি ট্রামখানায় । একেবারে গ্রামীণ জনপদে শান্তিরক্ষীর মাঠ পর্যায়ের কাজ গুলো ভালোই লাগছে। বাসার বারান্দায় দাঁড়ালে চোখের সামনে ভেসে ওঠে স্রাং পাহাড়ের অপরূপ দৃশ্যাবলি । এই পাহাড় আর গ্রামের সাথেই পেতেছি মনোরম এক মিতালি ।

আজ সকালে কমপংস্পু শহরে অবস্থিত সেক্টর সদরদপ্তর থেকে মেজর ডেভিড বেসলে হেলিকপ্টার রিকনিসনসের (শত্রু পক্ষের অবস্থান, তাদের শক্তি ইত্যাদি জানার উদ্দেশ্যে পরিচালিত অনুসন্ধানবাতদ সংক্রান্ত অভিযান । সামরিক বাহিনীতে সংক্ষেপে একে রেকি বলা হয় ।) বিষয়টি ওয়ারলেস সেটে নিশ্চিত করেছেন । ট্রাম খানায় আমাদের অবস্থান প্রায় তিন মাস হলেও নম্বর সেক্টরে (পশ্চিম), আমাদের পুরো দায়িত্বপূর্ণ এলাকা, বিশেষত এ অঞ্চলের দুর্গম পাহাড়ি এলাকা সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা এখনো সম্ভব হয়নি । সেই জন্যই হেলিকপ্টার মিশনের এই বিলম্বিত আয়োজন।

অক্টোবরের রোদেলা সকাল । নমপেনের পচেনতং আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে রাশিয়ার নির্মিত কমব্যাট রঙের হেলিকপ্টারে উঠেছি: ক্যামেরুনের পর্যবেক্ষক মেজর ফার্ডিন্যান্ড, কম্বোডীয় দোভাষী চো, পার্শ্ববর্তী বাসাত জেলার নির্বাচন কর্মকর্তা মার্সিলা ও আমি । এছাড়া কমপংস্পু থেকে আগেই হেলিকপ্টারে উঠেছে সেক্টর মনিটর টিমের সামরিক পর্যবেক্ষক মেজর ডেভিডবেসলে ও ক্যাপ্টেন জ্যাকসন ।
হাফ প্যান্ট পরা লাল চেহারার দুই রুশ যুবক এক হেলিকপ্টারের পাইলট । কিছুক্ষণ পর বিশাল এই রুশ ঘাসফড়িংটি টেক-অব করলো ।

আমরা যেন মুক্ত পাখির মতো উড়ে চলেছি নীল আসমানে । নীচে নমপেন নগরী। দুরে ওয়াটনম মন্দিরের উজ্জ্বল চূড়া, প্রিন্স সিহানুকের সোনালি রাজপ্রসাদ ও মিউজিয়াম । চোখে পড়ে সরীসৃপের মতো মেকংএবংটনলেস্যাপ নদীর আঁকাবাঁকা প্রবাহ । কী চমৎকার দৃশ্যপট!
চপারটি এবার দিক পরিবর্তন করে এয়ারপোর্টের পশ্চিম দিকে অবস্থিত ৩ নম্বর জাতীয় মহাসড়ক হয়ে দক্ষিণ দিকে আমাদের দায়িত্বপূর্ণ এলাকার উপর দিয়ে উড়তে থাকে । সহসা দৃশ্যের পরিবর্তন হয় । এই মহাসড়কের পশ্চিমে কমপংস্পু আরটাকেও প্রদেশের মধ্যে, স্রাং পাহাড়ের সবুজাভ বিস্তৃতি । এই পাহাড়ি এলাকাটি বিবদমান নমপেন সরকারি বাহিনী (সিপিএএফ) ও খেমাররুজ গেরিলাদের এক অঘোষিত যুদ্ধক্ষেত্র ।

উড়ন্ত বিহঙ্গ চোখে, নীচের সবুজ পাহাড়ি ও গ্রামীণ কম্বোডিয়া দেখছি । এই এলাকার সাথে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের অপরূপ পাহাড়ি এলাকার আশ্চর্য মিল রয়েছে । সবুজ ঢেউ খেলানো পাহাড়ি প্রান্তর । মাঝে মাঝে বিক্ষিপ্ত ঘরবাড়ি । কখনো হালকা বনভূমি । কোথাও সবুজধান ক্ষেত । সবমিলে চমৎকার এক বর্ণিল নকশা । কম্বোডিয়ার নীরব নিসর্গ আমার চোখের সামনে সৌন্দর্যের মোহময় মায়াজাল সৃষ্টিকরে । জানালার পাশে বসে, তন্ময় হয়ে আকাশ থেকে নীচের সুন্দর পৃথিবী দেখতে থাকি । ও পাশে ক্যাপ্টেন জ্যাকসন স্বদেশিনী মার্সিলার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিয়েছে । সবুজ স্রাং পাহাড়ের উপর দিয়ে উড়ছে আমাদের হাওয়াই যান। হেলিকপ্টারের স্বপ্নদ্রষ্টা লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিকে অভিবাদন । আল্লাহর কী অপরূপ সৃষ্টি আমাদের এই পৃথিবী । উপর থেকে দেখা সমগ্র কম্বোডিয়া যেন এক সুন্দর বাগান । কতিপয় নিষ্ঠুর মানুষ কেন তছনছ করতে চায় এই সুন্দর বাগানকে?

দো ভাষী চো জানালো, আমরা এখন খেমাররুজ নিয়ন্ত্রিত এলাকার উপর দিয়ে উড়ছি । কট্রর সমাজবাদী এই দলটি জাতিসংঘ বাহিনীকে শান্তি প্রক্রিয়ায় বর্তমানে আর সহযোগিতা করছেনা । এই দলটির নেতা কুখ্যাত পলপট । মেজর বেসলে পাইলটকে আরো নীচ দিয়ে ফ্লাই করতে অনুরোধ জানালো । দূরে একটি পাহাড় চূড়ায় বাসন্তি রংয়ের বৌদ্ধ মন্দির চোখে পড়ছে । পাহাড়ের উপর কয়েকটি ঘরবাড়ি । ওটা কি? খেমাররুজ গেরিলা আমাদের হেলিকপ্টারের দিকে একে-৪৭ রাইফেল উঁচিয়ে ধরে আছে । মুহুর্তের মধ্যে ওরা গুলি শুরু করলো । রোমাঞ্চকর আকাশ যাত্রা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ভয়াবহ আতংকে পরিণত হলো । ‘ওহগড’ বলে মার্সিলা ভয়ে চিৎকার করে ওঠে । আমি জানালা থেকে মুখ সরিয়ে নিই । মেজর বেসলে চিৎকার করে হেলিকপ্টারের গতি বাড়াতে বলে । শ্বাসরুদ্ধকর এক অবস্থা । এটা কি ট্রিগার-হ্যাপি খেমাররুজ গেরিলাদের অ্যাডভেঞ্চার নাকি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীকে হয়রান করার পরিকল্পিত প্রয়াস?

মহান আল্লাহকে ধন্যবাদ । সম্ভবত হেলিকপ্টারের ফুয়েলট্যাংক, ইঞ্জিন বা রোটারের মতো স্পর্শকাতর কোনো জায়গায় গুলি লাগেনি । পাহাড়ি এলাকা থেকে দ্রুত গতিতে বের হয়ে হেলিকপ্টারটি ততক্ষণে টাকেও প্রদেশের সীমানায় চলে এসেছে । সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, রিকনিসনস (পর্যবেক্ষণ) মিশন আজকের মতো সমাপ্ত ।
কিছুক্ষণ পর ট্রামখানায় তিউনিশিয়া ব্যাটালিয়নের মাঠে হেলিকপ্টারটি ল্যান্ডকরলো । হেলিকপ্টারের রোটারের ঘূর্ণনে বাতাসে প্রচণ্ড ধূলি উড়ছে । একটু পর চপার থেকে নেমে রুশ পাইলটদ্বয় হেলিকপ্টারের ক্ষয়ক্ষতির পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত হয়ে ওঠে । দেখা গেল খেমারুজ গেরিলাদের গুলিতে ল্যান্ডিং স্কিড ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে এবং মেইনবডির একটি জানালা ডেন্টহয়েছে । হেলিকপ্টার থেকে নামার সময় রুশ পাইলট জিজ্ঞাসা করলো, ‘আর ইউ ওকে মাদাম?’ নীরবে হাত নেড়ে গাড়িতে উঠে পড়ে মার্সিলা ।

ট্রাম খানায় নিজের রুমের গিয়ে আজকের ভয়ংকর ঘটনার কথা ভাবতে থাকি । হেলিকপ্টারে গুলি লেগে আজ কী মারাত্মক ঘটনাই না ঘটতে পারতো! প্রতিদিন বিকেলে গাড়িতে সংযুক্ত ওয়ারলেস সেটের মাধ্যমে সেক্টর মনিটর টিমকে ‘ওকে রিপোর্ট’ দিতে হয় । আজকের রিপোর্টে আমাদের হেলিকপ্টারে খেমাররুজ গেরিলাদের গুলি বর্ষণের ঘটনাটি জানানো হয়েছে । সেক্টরের প্রধান পর্যবেক্ষক (ফরাসি) কর্নেল কিফার আক্রমণের বিষয়টি তদন্ত করতে বলেছেন । আনটাক এই ঘটনার আনুষ্ঠানিক প্রতি বাদ জানাবে । ‘ওকে রিপোর্ট’ দিয়ে বাসায় এসে দেখি, আমাদের বাসার সামনে সংবাদপত্রের একটা গাড়ি ।

টাকেও প্রদেশ থেকে নমপেনে ফেরার পথে কয়েকজন সাংবাদিক আমাদের এখানে এসেছেন । আমাদের সহকর্মী মেজর লিকাবথ ইংরেজি-ফরাসি মিশিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে তাদেরকে আজকে রঘটনার বিশদ বর্ণনা দিচ্ছে । আমিবললাম, এটা পরিকল্পিত ফায়ারিং নাও হতে পারে । বরফ ঠান্ডা বিয়ার নিয়ে কম্বোডিয়া টাইমসের (ব্রিটিশ) সাংবাদিক কেলভিন ব্যারিংটন একটি রিপোর্টের মুসাবিদা করতে থাকে… খেমাররুজ ফায়ারস এট ইউ এন হেলিকপ্টার…।

বেশ কিছুক্ষণপর স্থির হয়ে, কম্বোডিয়ায় শান্তিরক্ষীর ঝুঁকিপূর্ণ জীবন আর কম্বোডিয়ায় শান্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে একাকী ভাবতে থাকি । নমপেন থেকে কম্বোডীয় বন্ধু সাকুনথা চিঠিতে জানিয়েছে, আগামী ৭ নভেম্বর নমপেনে জল উৎসব অনুষ্ঠিতহবে । পূর্ণিমার রাতে হাজার হাজার নমপেনবাসী দুই নদীর সঙ্গমস্থলে মিলিতহবে । ঐ দিন টনলেস্যাপ নদীর স্রোত আশ্চর্যজনক ভাবে বিপরীত দিকে প্রবাহিক হবে । পৃথিবীতে এমন নদী আরনেই । এ ভাবে রোমান্স,উৎকণ্ঠা কিছুটা হতাশা, অবশেষে আশা নিয়ে কম্বোডিয়ায় কেটে যায় আরো একটিদিন ।

লেখক কম্বোডিয়ায় শান্তিরক্ষী মিশনে একজন সামরিক পর্যবেক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন : নমপেন,কম্বোডিয়া, ২৫ অক্টোবর, ১৯৯২
E-mail :[email protected]


সর্বশেষ

আরও খবর

নির্মাতা সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী আর নেই

নির্মাতা সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকী আর নেই


তুরাগে নৌকাভ্রমণ উপভোগ করলেন ম্যাখোঁ

তুরাগে নৌকাভ্রমণ উপভোগ করলেন ম্যাখোঁ


জনস্বাস্থ্যে বাংলাদেশকে ২০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন করেছে বিশ্বব্যাংক

জনস্বাস্থ্যে বাংলাদেশকে ২০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন করেছে বিশ্বব্যাংক


ডিএমপি হেডকোয়ার্টার্সে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সৌজন্য সাক্ষাৎ

ডিএমপি হেডকোয়ার্টার্সে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সৌজন্য সাক্ষাৎ


একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহতদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা

একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহতদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা


২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায়: এর্টনি জেনারেল

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায়: এর্টনি জেনারেল


নির্বাচনের মাঠে শেরে বাংলার উত্তরসূরি ফাইয়াজুল হক

নির্বাচনের মাঠে শেরে বাংলার উত্তরসূরি ফাইয়াজুল হক


বেলজিয়ামে ই-পাসপোর্ট কার্যক্রমের উদ্বোধন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর

বেলজিয়ামে ই-পাসপোর্ট কার্যক্রমের উদ্বোধন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর


শেখ রেহানার ১৯৭৯ সালের সেই ভাষণ

শেখ রেহানার ১৯৭৯ সালের সেই ভাষণ


মাত্র ২৬ বছরে যে প্রদীপ নিভে যায়

মাত্র ২৬ বছরে যে প্রদীপ নিভে যায়