
গোঁসাই পাহ্লভী:
অনেকদিন পর আবদেল মাননানের কবিতা পড়তে গিয়ে সুলতানের কথা মনে পড়লো, আসুন কি কারণে পড়লো সেটা একটু জেনে নেই।
মাননান লিখেছেন,
‘কোটি কোটি কালো মর্মের অক্ষর
যুদ্ধ বর্ণনার ঢাল নানা রঙে আঁকা
পতাকায় রক্তের দাগ টানে সীমান্ত রেখা।’
এরপর আশ্চর্যজনকভাবে কবিতার গন্তব্য ফিনিটের রাস্তা বাঁক নিয়ে সোজা ইনফিনিট সাজেশনের বিশ্বরোডে,
দেখুন কি লিখেছেন,
‘মনের চরকা সূর্যে সুতো বেঁধে ঘোরে
সময় ঝড়ে পড়ছে কব্জি বেয়ে
সুলতানের বলিষ্ঠ রেখায় মোড়া বাতাসের ডানা
ঝড়ো রাতে অন্য পৃথিবীর দরজা খুলে ডাকে।’
এই কবিতাটা সুফির সফরসূচি কাব্যগ্রন্থের ‘কাঁপে না অ্যাপেল পাতা’ কবিতার অংশ বিশেষ।
মাননান কবিতায় কি বলতে চেয়েছেন, মন প্রাণ সত্তা, সুলতান, এবং আরো আছে নানান ন্যারেটিভ, এইসব সুলতানকে নতুনভাবে পরিচিত করাবে না, সুলতান বাঙলায় একটা সভ্যতা। কিন্তু এইসব, কবিতায় তথা চিন্তায় নতুন কিছু নির্দেশনা দেবে এতে কোনও সন্দেহ নেই।
মাননানের শেষের কয়েকটি লাইন আবার পুনরাবৃত্তি করি, যেমন ‘মনের চরকা সূর্যে সুতো বেঁধে ঘোরে’, মাননান এখানে জানেন যে, সুতা মানে সম্পর্ক, সূত্র, সূত্রধর। মনের চরকা বলেছেন, মন নিজে চরকা নয়। এরপর, সময় ঝড়ে পড়ছে কব্জি বেয়ে, এটা নিশ্চই আমাদের কাছে পরাবাস্তব লাগবে না। আপনাকে এই অভিজ্ঞতা খুজতে হবে না, আপনার নিজের ক্ষেত্রেও এরকম ঘটে। তারপর বলেছেন, ‘সুলতানের বলিষ্ঠ রেখায় মোড়া’ , কি মোড়া? ‘বাতাসের ডানা’, সেই ডানা কি করে? ‘ঝড়ো রাতে অন্য পৃথিবীকে দরজা খুলে ডাকে’।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে সুলতান কি তার জীবন-যাপন কিংবা কর্মে কোথাও অন্য পৃথিবীর’ কথা বলেছেন, না আছে সেরকম কোনো ইঙ্গিত? এখানেই কবিতার নন্দনতত্ত্ব দর্শনের পায়ের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। সে আর এগুতো পারছে না, আগাতে হলে দর্শনের জবানে আগাতে হবে। কারণ, প্রশ্নটি দর্শনের এলাকায় ঢুকে গেছ। নাগরিক করেছে।
সুলতানের পেইন্টিংস কিংবা তার জীবন-যাপন যে পৃথিবীর সাক্ষ্য দেয়, সেটা ‘অন্য’, ‘ভিন্ন’, ‘বাঙালী’ বা ‘মুক্তি’ এরকম কোনো পৃথিবীর নয়, সুলতান এক সনাতন জীবন-যাপনের চিত্র এঁকেছেন, তিনি নিজেও সেরকম একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র। তিনি কৃষকদের যে জীবন-যাপন দেখিয়েছেন, সে দৃশ্য এখনোও গ্রাম বাংলায় দেখা যায়, যে দর্শন তিনি ধারণ করেছেন, একই কথা কবিরের জীবন থেকে পাওয়া যায়, ফলে সুলতান নতুন কি বললেন?
সুলতান নতুন কিছুই বলেননি, সুলতান নতুন নির্দেশনা দিয়েছেন, একটা দিশা দিতে চেষ্টা করেছেন। পুরনো দৃশ্য বা চলমান খন্ডিত দৃশ্য দেখিয়ে অখন্ডতা কীভাবে ক্ষয়ে যাচ্ছে সেই নির্দেশনাই দিয়েছেন, এর মাঝে দেখিয়েছেন কীভাবে প্রাকৃতিক সম্পর্ক চর্চার মধ্যে দিয়ে নানান প্রতিকুলতা সত্তেও ভূমিপুত্ররা টিঁকে থাকে!
প্রথম বৃক্ষ রোপণের কর্তা হিসাবে তিনি একজন কৃষককেই দেখিয়েছেন, দেখিয়েছেন কীভাবে প্রাণের মধ্যে দিয়ে সম্পর্কের বীজ ছড়িয়ে দিতে হয়। একটি সাক্ষাৎকারে সুলতান বলেছেন, ‘বাঙালীর কোনো ধর্ম নেই’ এইকথা এখনকার কোনো মানুষ বিশ্বাস করবেন? বাঙালীর এখন হিন্দু ধর্ম আছে, আছে মুসলিম সহ নানান ধর্ম। শুধু ধর্মই নেই, ধর্মের ভেতর আন্তঃসংঘাত আছে, অপর ধর্মের লোকজনদের উপরে হামলা হত্যাখুনও রয়েছে।
তাহলে বাঙালীর কোনো ধর্ম নাই্ মানে তিনি এই বাঙালীর কথা বলেন নাই, তিনি যে বাঙালীর কথা বলেছেন, সে বাঙালী আর যেই হোক না কেন, অন্য বাঙালী নন, অন্য পৃথিবীর কোনও প্রাণীও নন, সুলতানের মানুষগুলোকে যদি আমরা এখনোও চিনতে না পারি তাহলে নিজেদের অন্ধ বলে স্বীকার করে লওয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
লেখক: ভাস্কর ও শিল্প সমালোচক
নিউজনেক্সটবিডি ডটকম/টিএস