
ফারহানা করিম চৌধুরী, ডেস্ক: নির্বাচনি প্রচারণার সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন সম্পর্কে অনেক বিদ্বেষপূর্ণ কথাবার্তা বলেছেন। সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট বিতর্কে তাকে ন্যাস্টি ওমেন বা জঘন্য নারী বলে উল্লেখ করেছিলেন।হিলারি এবং ট্রাম্পের সম্পর্কের তিক্ততা এতোটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, ধনকুবের এই ব্যবসায়ী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে প্রথমেই সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জেলে ঢুকাবেন বলে হুমকিও দিয়েছিলেন। হিলারিও ট্রাম্পকে ছেড়ে কথা বলেননি।
নারীদের অবমাননা করে তিনি যেসব কর্মকাণ্ড করেছেন তার ফিরিস্তি তুলে ধরেছেন জনগণের সম্মুখে। তবে পরস্পরের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন এই দুই প্রার্থীর সম্পর্ক আগে বেশ মধুর ছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং মেলানিয়ার বিয়ের একটি ছবি অন্তত সেই সাক্ষ্যই দেয়। ছবিতে হাস্যোজ্জ্বল হিলারি-ট্রাম্পকে দেখলে অনেকেই বিস্মিত হবেন এবং ভেবে অবাক হবেন ক্ষমতার লড়াই মানুষের সম্পর্ককে কতটা বদলে দিতে পারে।
২০০৫ সালের জানুয়ারিতে মার-আ-লাগো এস্টেটে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং মেলানিয়া নাউসের বিয়ের অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নিউইয়র্কের তৎকালীন সিনেটর হিলারি ক্লিনটন এবং তার স্বামী সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন।
অথচ ২০১৬ সালের অক্টোবরে মিসৌরির সেন্ট লুইসের প্রেসিডেন্ট বিতর্কের ছবিটার দিকে এক নজরে দেখা যেতে পারে। হিলারি যখন দর্শকদের উদ্দেশ্যে কথা বলছিলেন তখন তার পিছনে চেয়ার ধরে কঠোর মুখ করে বিদ্বেষপূর্ণ দৃষ্টিতে হিলারির দিকে তাকিয়ে ছিলেন ট্রাম্প। দর্শকদের সারির সামনের দিকে ছিলেন এমন তিনজন নারী যারা বিল ক্লিনটনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেছিলেন। হিলারিকে বিব্রত করার উদ্দেশ্যে এই নারীদের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ট্রাম্প। দর্শকসারিতে সেদিন স্বামী বিল ক্লিনটন ছাড়াও কন্যা চেলসি ক্লিনটনও উপস্থিত ছিলেন। মূলত প্রথম বিতর্কে হিলারির কাছে ধরাশায়ী হওয়ার পর দ্বিতীয় বিতর্কে এই কৌশল অবলম্বন করেছিলেন ট্রাম্প।
মাত্র এক দশকের ব্যবধানে সম্পূর্ণ দুটি ভিন্ন ছবি মার্কিনীদের হজম করতে হলো। একটিতে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে ট্রাম্প-হিলারি-বিল এবং মেলানিয়া। অপরটিতে হিলারিকে পরাস্ত করতে বিল ক্লিনটনের কলংকজনক অতীত থেকে তিনজন নারীকে ডেকে নিয়ে আসার ট্রাম্পীয় প্রচেষ্টা।
এবারের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দুজন প্রার্থীই নিউইয়র্কের বাসিন্দা ছিলেন। ৭২ বছর আগের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা রিপাবলিকান প্রার্থী থমাস ডিউই এবং ডেমোক্রেটিক ফ্রাংকলিন ডি রুজভেল্টও নিউইয়র্কের ছিলেন। সেসময় নির্বাচনি প্রচারণায় ৪২ বছর বয়সি নিউইয়র্কের সাবেক গভর্নর ডিউই তার প্রতিদ্বন্দ্বী ৬২ বছর বয়সি রুজভেল্টের প্রতি ট্রাম্প স্টাইলে আক্রমণ করেছিলেন। তিনি ডেমোক্রেটিক প্রার্থীকে ‘ক্লান্ত বৃদ্ধ’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।
হিলারি এবং ট্রাম্প উভয়েই নিউইয়র্কে বাস করেন। ২০০০ সালে হোয়াইট হাউজ ত্যাগ করার পর ক্লিনটন পরিবার ওয়াশিংটন থেকে নিউইয়র্কে চলে আসেন। এবং হিলারি নিউইয়র্ক থেকে ডেমোক্রেটিক সিনেটর নির্বাচিত হন।
একই সময়ে নিউইয়র্কের আবাসন ব্যবসায়ী ধনকুবের ডোনাল্ড ট্রাম্প উপলব্ধি করেছিলেন, গলফের মাধ্যমেই সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের অন্তরঙ্গ হওয়া যেতে পারে। তিনি বিল ক্লিনটনের চরিত্রের সঙ্গে তার সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছিলেন।
নিজের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য একসময় প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান এবং তার স্ত্রী ন্যান্সি রিগ্যানকে তোয়াজ করেছিলেন ট্রাম্প। ক্লিনটন পরিবারের সঙ্গেও একই কাজ করার চেষ্টা করেন তিনি।
ট্রাম্প নিউইয়র্কের ওয়েস্টচেস্টার কাউন্টিতে একটি গলফ কোর্স কিনে নেন। ক্লিনটনদের বাড়ি থেকে ছয় মাইল দূরে এটির অবস্থান। ট্রাম্প এই গলফ ক্লাবে বিল ক্লিনটনের সঙ্গে গলফ খেলেছেন। এছাড়া সাবেক প্রেসিডেন্টকে তোষামোদি করে সেখানে তার ছবিও ঝুলিয়ে রেখেছেন। জুন মাস পর্যন্ত ট্রাম্পের গলফ ক্লাবে বিল ক্লিনটনের একটি লকার ছিল।
ট্রাম্প একবার বলেছিলেন, তিনি গলফ ক্লাবটি পুনর্নির্মাণ করেছিলেন কারণ তিনি জানতেন, বিল ক্লিনটনের খেলার জন্য একটি জায়গার প্রয়োজন হবে। ইএসপিএনের জ্যেষ্ঠ লেখক ডন ভ্যান নাট্টা জুনিয়র তার ‘ফার্স্ট অব দ্য টি’ নামক বইয়ে লিখেছিলেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট বিলের সঙ্গে গলফ খেলা খুব উপভোগ করতেন ট্রাম্প। তিনি ভ্যান নাট্টাকে বলেছিলেন, ‘বিল যদি একটি শট মিস করেন, তিনি সজোরে আরেকটি শট নিতে চাইতেন। এটা জীবনের মত।’
বর্তমানে নব নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ক্লিনটন দম্পতির এতই খাতির ছিল যে, তিনি নিজের ফাউন্ডেশন থেকে ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে ১ লাখ ডলার দান করেন।
মাইকেল ক্রানিশ এবং মার্ক ফিশারের লেখা ‘ট্রাম্প রিভিলড’ বইয়ে দেখা গেছে, ২০০২ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত হিলারির সিনেট যুদ্ধের তহবিলে ৪ হাজার ৭০০ ডলার দান করেন ট্রাম্প।
এছাড়া ১৯৯৯ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে ট্রাম্প বিভিন্ন সময়ে পার্টি পরিবর্তন করেন। অর্থাৎ প্রথমে তিনি রিপাবলিকান পার্টির হয়ে রেজিস্ট্রেশন করেন। পরবর্তীকালে তিনি ইন্ডিপেনডেন্স পার্টির সদস্য হন। এরপর ডেমোক্রেটিক পার্টিতে চলে আসেন। সর্বশেষ তিনি আবারো রিপাবলিকান পার্টিতে ফিরে আসেন। এভাবে তিনি ৭ বার দলবদল করেন।
ক্লিনটন পরিবারের সঙ্গে ট্রাম্পের যে বন্ধুত্ব তাকে ব্যক্তিগত হিসেবে না দেখে লেনদেনের সম্পর্ক হিসেবে বিবেচনা করাই শ্রেয়। মূলত নিজের ব্যবসার প্রয়োজনে তিনি সাবেক প্রেসিডেন্টের পরিবারের সঙ্গে যুক্ত হন। ক্লিনটনদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ক্লিনটনদের সময়ের হোয়াইট হাউজের একজন কর্মকর্তা স্পষ্টভাবে জানান, যেখানে অর্থ সেখানেই ক্লিনটনদের পদচারণা।
ট্রাম্পের তৃতীয় বিয়েতে নিমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকা নিউইয়র্ক সিটির সাবেক পুলিশ কমিশনার বার্নার্ড কেরিক বলেন, ‘তারা সবাই একই শহরে থেকে একই মানসিকতা নিয়ে অভিন্ন খেলা খেলেছেন। ব্যবসা গড়ে তুলতে সম্পর্কের উন্নতি করেছেন। এটা পুরোটাই টাকার খেলা।’
ক্লিনটন পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ট্রাম্পকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ী হিসেবে সব রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হয়। আমি বলবো না যে, এটা খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।’
সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিন
সম্পাদনা: জাহিদ