
আলীম হায়দার: সুনাগরিক, গুনীজন এবং যোগ্যদের সম্মান যথাযথ স্থানে রেখে জনগণমনে আধুনিক নেতৃত্বের এর অভিনব দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যাচ্ছেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। এমন ঘটনারই সর্বশেষ সংযাজন কবি হেলাল হাফিজের ঘটনাটি। সুনাগরিকের জন্য ভালোবাসা দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। ভালো ও গঠনমূলক কর্মে সম্মান যোগ হয়, তেমনই একটি উদাহরণই এটি। চাওয়া-পাওয়ার বাজে সংস্কৃতির যুগে আমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে মানুষকে সম্মানিত করার ঘটনা প্রায় বিরল। আমরা তো সাধারণ মানুষরাই সম্মানিত ব্যক্তিদের প্রাপ্য সম্মান দিতে অস্বীকার করি। সেখানে দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজে যখন যোগ্যতার বিচারে নির্দলীয় ব্যক্তিদের পর্যন্ত ভালোবাসা দিতে কার্পণ্য করেন না-তখন বুঝতে হবে, পরিবর্তন আসছে। চলমান রাজনীতি উন্নতচিন্তার দিকে ধাবিত হচ্ছে। একটি মহান রাস্তা দেখানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই অঢেল ভালোবাসা পাবেন। প্রাণঢালা অভিনন্দন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে।
এদিকে, নিজের চিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য নেয়ায় অনেকে কবির সমালোচনা করতে শুরু করেছেন। তাদের উদ্দেশ্যই বলছি। ঘটনা এখানে দুটি। প্রথমত, কবি হেলাল হাফিজ নিজের চিকিৎসার জন্য কাউকে হাতে-পায়ে ধরেননি। দ্বিতীয়ত, কবির অসুস্থ্যতার খবর জানার পর তাকে ডেকে নিয়ে গেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। কবির সম্মান যেমন এখানে ভূলুন্ঠিত হয়নি। তেমনি সরকার প্রধানের মাহাত্ম্যও খোয়া যায়নি। শিক্ষিত প্রজন্মের কাছে এটা ইতমধ্যে পরিষ্কার হয়ে গেছে। শিক্ষিত নেতারা যোগ্য ব্যক্তিদের সম্মান দিতে জানেন। এতে যে রাষ্ট্রের সম্মান বাড়ে তা তারা বোঝেন। অশিক্ষিতদের কাছে অন্যের মানহানিটাই নিজের মান বৃদ্ধির উপায় হতে পারে, তবে বিবেচনােবাধ সম্পন্ন মানুষদের কাছে তা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শুধু শিক্ষিতই নন, বড় হৃদয়ের মানুষও বটে। মানুষের প্রয়োজনে সব প্রটোকল থেকে বেরিয়ে এসেও তিনি মানুষকে বুকে জড়িয়ে নিতে জানেন।
অনেকদিন ধরেই সংবাদ মাধ্যমে নিয়মিত লেখা আসছিল কবির শারীরিক অবস্থা নিয়ে। কোনভাবে হয়তো খবরটা জেনে থাকতে পারেন তিনি। কবিকে নিয়ে সম্প্রতি দেশের শীর্ষ অনলাইনে কর্মরত রিফাত রহমান নামের এক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধির তুখোড় সংবাদটি দেশজুড়ে আলোচনা সৃষ্টি করেছিল। এখনো ফেসবুকে ফেসবুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেটি।
কবির এক চোখ যে নষ্ট হয়ে গেছে এবং আরো এক চোখেও যে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে, সে তথ্য সারা দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে সবে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত এই তরুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি। এরপরেই দেশ বিদেশ থেকে কবির জন্য সাহায্য-সহযোগিতা এবং ভালোবাসা আসতে শুরু করে। প্রবাসীরাও অর্থ দিয়ে সাহায্য করতে চান তাকে। কিন্তু নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দেননি কবি। কারো দয়া বা দান গ্রহণ করবেন না বলেই জানান তিনি। এর আগেও এ ব্যাপারে অনড় ছিলেন তিনি। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারো চোখ দেখাতে যান কবি। সেখানে কবিভক্ত ডাক্তারের মাধ্যমে প্রথমে প্রধানমন্ত্রীর অফিস, পরে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে কবির সর্বশেষ অবস্থা সম্পের্ক তথ্য চলে যায়। এরপরেই কবিকে ডেকে বসেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আমন্ত্রণ পেয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করেন। এরপর সেখানেই তার চিকিৎসার দায়িত্ব নেয়ার ঘোষণা দেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা। পিতার মতোই হিমালয় হৃদয় পেয়েছেন তিনি। কবির প্রতি ভালোবাসা দিয়ে দেশ, জাতি এবং ইতিহাসকেই যেন আবারো সম্মানিত করলেন এই মমতাময়ী নেত্রী।
কেন এ কথা বলছি, কারণ আছে। হেলাল হাফিজ কোন কবি সেটা আপনাকে জানতে হবে। ব্যক্তি জীবনে তার অর্থকড়ি যোগ হয়নি। ধনসম্পদের সুখে ডুবে থাকার মতো ভাগ্য হয়তো তার হয়নি অথবা তিনি সেটা চাননি। কিন্তু তার ঐশ্বর্য পরিমাপ করার মতো পাকা জহুরী এই দেশে আছে বলে আমরা অনেকেই বিশ্বাস করিনি। কিন্তু আমাদের ধারণা ভেঙ্গে দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। তিনি আওয়ালীগ সভাপতি, ক্ষমতাশীন দলের সর্বোচ্চ ব্যক্তি। আর কবি হেলাল হাফিজ একজন নিক্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তি। কোন দলের হয়ে মাঠে ময়দানে নেই তিনি। এমনকি অন্দরেও নেই। সাধারণ নাগরিক তিনি। অথচ তারপরেও তাকে ডেকে নিয়ে সম্মানিত করলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু কেন? কারণ, জাতির প্রতি কবির অবদানকে ভুলে যাননি তিনি। আরো বড় ব্যাপার হলো, চব্বিশ ঘন্টা রাজনীতির মধ্যে থেকেও ব্যাপারগুলো তিনি বেশ ভাল ভাবেই জানেন। আমাদের মমতাময়ী প্রধানমন্ত্রী। নিজের হাসির মতোই মনটাও যে মিষ্টি, তার আরো একটি প্রমান দিলেন তিনি।
হ্যা, আমি উনিশশো উনসত্তরের গণআন্দোলনের কথাই বলছি। আর সে আন্দোলনের আগুন শ্লোগানের রচয়িতা এই কবি। কালে কালে দ্রোহের শ্লোগানে পরিণত হয়েছে সেই সময় কবির রচিত নিষিদ্ধ সম্পাদকীয় কবিতায় লাইন দুটি- ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ গণ আন্দোলনের প্রতিটা মিছিল মুখরিত হয়েছে এই কবির কবিতার চরণ, দেয়ালে দেয়ালে এই লাইনগুলি যেন নীরব শ্লোগানের আগুন ঝড়িয়েছে দিবানিশি। স্বাধীনতা থেকে স্বৈরাচার বিরোধী ও গণতন্ত্র প্রতিষ্টার আন্দোলণ পর্যন্ত কোথায় ছিল না এই পংক্তুগুলি!
হেলাল হাফিজ এমন একজন কবি, যিনি কিনা স্বয়ং ইতিহাসের সাক্ষী, ইতিহাসের অংশ, এমনকি ভাগীদারও বটে। তাকে এতদিন পর্যন্ত কেউ কিন্তু ভালোবেসে একদিন চায়ের কাপে চুমুক দেয়ার জন্যেও আমন্ত্রণ জানায়নি। এমনিতেও তিনি নিভৃতচারী। আর কবিও নিজেকে ছোট করে কারো কাছে যেতে চাননি। তবে, এবার তার অসুস্থ্যতার খবর পাওয়ার পর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তাকে, তিনিও সানন্দে সাক্ষাত করতে গেছেন দেশের সরকার প্রধানের সাথে। এই ডাকে কবির সম্মান থেকে গেছে তবে অভিমান ঝরে গেছে। আর এই দেশ একজন আপাদমস্তক শিক্ষিত, সৎ, মমতাময়ী প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে জন্যেই এটা সম্ভব হয়েছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এই দৃষ্টান্তগুলোই আমাদের সুনাগরিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার প্রেরণা যোগাবে। পরমুখাপেক্ষী অথবা সুযোগ সন্ধানী হওয়ার প্রবণতা রোধ করবে আমাদের ভিতর থেকে। আমাদের ব্যক্তিত্ববাদের বিকাশে এ ঘটনাগুলি সাহস যোগাবে। আপনি শুধু প্রধানমন্ত্রী কিংবা বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেই একথা বলছি না, আপনি নতুন প্রজন্মের সামনে নতুন পথের কাণ্ডারী। সাহস ও প্রেরণাদায়ী। আপনাকে শুধু ধন্যবাদ নয় প্রিয় নেত্রী, আজীবন কবিতার ভালোবাসায় অবগাহন করুন আপনি। আপনাকে হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা দেয়া যায়। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রিয় নেত্রী।
লেখক: কবি, সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক